অনলাইন ডেস্কঃ
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে ‘জন্মদিনের পার্টির’ দাওয়াত দিয়ে তরুণীকে বাসায় এনে রাতভর ‘ধর্ষণের’ পর ভোরে বের করে দেওয়ার মামলায় ব্যবসায়ীর ছেলে বাহাউদ্দিন ইভানকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঘটনার দুদিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ইভানকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পুলিশের এই বাহিনীর দাবি, ইভান ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আজ শুক্রবার সকালে র্যাব কার্যালয়ে তাঁকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।
তবে ঘটনার পর নিজের বাসা থেকে কীভাবে পালিয়ে যান ইভান, তার বর্ণনা দিয়েছেন ওই বাসার দুজন দারোয়ান। আর তাঁকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হয়, তার বর্ণনা দিয়েছে র্যাব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনানীর ২ নম্বর রোডের ৫/এ ন্যাম ভিলেজ বাসার দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে ইভানের পরিবার। ওই বাসাটিতে তাঁরা মাসিক ৪৫ হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। তবে ওই বাসার সঙ্গেই তাঁদের নিজেদের একটি টিনশেড বাসা রয়েছে, যার নাম ‘নাজনীন ভিলা’।
‘ইভান বলে, মেয়েটাকে বের করে দাও’
ঘটনার রাতে ইভানদের বাসায় নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মো. মাসুদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘ওই তরুণী রাত ১২টার দিকে রিকশায় করে আসেন। ইভান নিজে তাঁকে রিসিভ করে। আমি বলছি, মামা (ইভানকে) এই মেয়েটা কে? ইভান বলছে, আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। এরপর বাসায় নিয়ে গেল তরুণীকে। হাসতে হাসতে ওপরে গেল দুজন।’
“তারপর রাত সাড়ে ৩টা/৪টার দিকে ওপরে চিল্লাচিল্লি শুনতে পাই। এরপর আমি সঙ্গে থাকা আরেক দারোয়ানকে ডাকলাম। এর মধ্যেই ইভান এসে বলে, ‘মেয়েটাকে বের করে দাও।’ আমি বলি, ‘আমি এই মেয়ের গায়ে হাত দিতে পারব না। তুমি বের করে দাও।’ তখন সে নিজেই মেয়েটাকে বের করে দেয়। কিন্তু মেয়েটি বারবার বলছিল, ‘আমি এত রাতে কই যাব?’ বের করে দেওয়ার পর মেয়েটি রাস্তার উল্টাপাশের বাসার গেটের সামনের ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।”
মাসুদ মিয়া আরো জানান, সকাল ৭টায় বনানী থানার পুলিশ ইভানের বাসায় আসে। এরপর পুলিশ তাঁকে ও ইভানের বাবাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। ইভানকে বাসায় পায়নি পুলিশ।
ইভানের পালিয়ে যাওয়া
নিরাপত্তারক্ষী মো. মাসুদ মিয়ার দায়িত্ব শেষ হওয়ার কথা সকালে। কাছাকাছি সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেলে সেখানে দায়িত্ব পালন করতে আসেন বাসার অপর নিরাপত্তারক্ষী উসমান গণি। তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, সকাল ৮টার কিছু পরে ইভান বাসা থেকে বের হয়েছেন তাঁর চোখের সামনে দিয়ে। এ সময় ইভানের পরনে একটি গেঞ্জি ও জিন্স প্যান্ট ছিল।
‘খালি হাতে ওপর থেকে নেমে কাউকে কিছু না বলে একাই দরজা খুলে বের হয়ে যান ইভান। তিনি বেশির ভাগ সময় নিজের মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। তবে সকালে যখন বের হন, তখন বাইক না নিয়েই বের হন।’
সকালে বের হয়ে যাওয়ার পর ইভানকে আর বাসায় ফিরতে দেখেননি নিরাপত্তারক্ষী উসমান গণি।
গত মঙ্গলবার রাতে ইভানের বাসায় তাঁর জন্মদিনের কোনো অনুষ্ঠান ছিল কি না জানতে চাইলে উসমান গণি বলেন, ‘না, আমার জানা নেই। কারণ, জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলে অনেক আয়োজন হতো। আর আমরা অবশ্যই জানতে পারতাম।’
‘বারবার জায়গা পরিবর্তন করে ইভান’
র্যাব দাবি করেছে, ইভান পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের জানিয়েছেন। আজ র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ এই দাবি করেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, গত বুধবার (৫ জুলাই) পুলিশ যখন ইভানের বাসায় অভিযান চালায়, তখন তিনি বাসার ছাদে আত্মগোপনে ছিল। পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাসা থেকে চলে যাবার পর তিনি বাড়ি থেকে বের হন। এরপর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় আবার আত্মগোপন করেন।
‘সেই সন্ধ্যায় ইভান উত্তরার কাওলা এলাকায় যান। এর পরে সেখান থেকে আবার দক্ষিণখান এলাকায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় যান এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করেন।’
র্যাব কর্মকর্তার দাবি, পরের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) সকালে ইভান উত্তরা থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করেন। প্রথমে উত্তরা থেকে বাসে করে গুলিস্তান, এরপর নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় পৌঁছান। তারপর তিনি ফতুল্লার দেওভোগে তাঁর খালার বাসায় (২৬০/২ পশ্চিম দেওভোগ, ফতুল্লা) যান দুপুর আড়াইটার দিকে। সেখান থেকে বিকেলে সাড়ে ৪টায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযানের সময় বাসাতেই ছিল ইভান
র্যাব ও দুই নিরাপত্তারক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী এটা স্পষ্ট, পুলিশ যখন ওই বাসায় অভিযান চালায়, তখন ইভান বাসায় ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে পায়নি। পুলিশি অভিযানের প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান।
গত বুধবার ইভানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন এক তরুণী (২১)। ওই তরুণী রাজধানীর বাসিন্দা। তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই তরুণীর ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়।
এর আগে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ এনে গত ৬ মে বনানী থানায় মামলা করেন এক ছাত্রী। এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পুলিশ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তাঁর বন্ধু নাঈম আশরাফকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা এখনো কারাগারে আছেন।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর অভিজাত এলাকায় আরো একটি ধর্ষণের অভিযোগ পেল পুলিশ।
মামলার এজাহারে ওই তরুণী উল্লেখ করেছেন, ১১ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁদের বন্ধুত্ব হয়। এর সূত্র ধরেই তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো এবং ঘোরাঘুরি করতেন তাঁরা। চার মাস আগে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সূত্র ধরেই ওই রাতে তিনি ইভানের বাসায় যান।
ওই তরুণী আরো উল্লেখ করেন, ‘বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কোনো আলামত দেখি না। আমি ভয় পাই এবং বাসায় আসতে চাই। কিন্তু সে বাসায় আসতে দেয় না। সে আমাকে রাতে খাবার খাওয়ায় এবং নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়।
রাত দেড়টায় ইভান ধর্ষণ করে বলে তরুণী এজাহারে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমি চিৎকার করিতে থাকিলে সে রাত সাড়ে ৩টায় আমার ব্যাগ রেখে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।’
‘আসামি আমাকে এর আগেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করে। আমাকে ভয় দেখায়, মুখ খুলিলে তাহার নিকট আছে এমন খারাপ ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিবে’, এজাহারে বলেন তরুণী।
সুত্র, ntv