সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আজ কোনো দেশ বা জাতির একক সমস্যা নয়। ধনী-গরিব, উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশের জন্যই এটি সমস্যা। বিশ্ব শান্তির জন্য জঙ্গিবাদ মারাত্মক হুমকি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এ ব্যাটালিয়নের প্রতি সদস্যকে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাজশাহী সেনানিবাসে শহীদ কর্নেল আনিস প্যারেড গ্রাউন্ডে ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে জাতীয় পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার, সেনাবাহিনীর বগুড়ার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. মোশফেকুর রহমান, বাংলাদেশ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট সেন্টার (বিআইআরসি) কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ আশরাফউল কাদের ও এডহক প্যারা কমান্ডোর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দীন মাহমুদ চৌধুরী। এছাড়া ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সফল জিম্মি উদ্ধার অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ১৩ জন দেশ-বিদেশি নাগরিককে উদ্ধার করে। এতে দেশের ভাবমূর্র্তি উজ্জ্বল হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আতিয়া মহলে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ সাহসিকতার সঙ্গে পরিচালনা করে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।
তিনি বলেন, আধুনিক ও যুগোপযোগী ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১’র ধারাবাহিকতায় এবং ফোর্সেস গোল-২০৩০’র আলোকে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বিন্যাস ও পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের আধুনিকায়ন অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনী আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য বাহিনী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। স্পেশাল ফোর্স ও কমান্ডোদের আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং সমরসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে।
আব্দুল হামিদ আরও বলেন, ‘সামরিক জীবনে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ ও সর্বোত্তম প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার অল্পসময়ের মধ্যে ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন বাঙালি জাতির সুনাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া যৌথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ ও পারস্পরিক সৌহাদ্যের দ্বার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উন্মুক্ত করছে। এই ধারাবাহিকতা আগামীতে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি। বিশ্বের উন্নত সেনাবাহিনীর মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ, দুর্যোগ মোকাবেলা ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তারা তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করছি।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের আস্থা ও গর্বের প্রতীক। আর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা এর গর্বিত অংশীদার। এই ফোর্সের সদস্য তথা কমান্ডোরা দেশের চৌকস, সুশৃঙ্খল এবং দুঃসাহসী সেনানী। মাতৃভুমির সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে তারা জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ ও আত্মোৎসর্গ করার সংকল্পে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকাত্মিক প্রচেষ্টায় সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি স্থাপন করেন এবং প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ও কঠোর শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পেশাদারিত্বেও পাশাপাশি দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা জানাতে উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জনগণ কারা? জনগণ তোমাদের বাপ, তোমাদের ভাই। এ কথা তোমরা মনে রেখ। তোমাদের মাইনে আসে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের ট্যাক্স থেকে। তোমরা সেই দুঃখী মানুষের মালিক নও, তাদের সেবক। তাদের অর্থে তোমাদের সংসার চলবে। তোমরা অবশ্যই অন্যায় দমন করবে। তবে খেয়াল রেখো— নিরপরাধ মানুষের ওপর যেন অন্যায় কিছু না হয়।’
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় সেই ঐতিহাসিক দিন থেকে শুরু করে অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে সেনাবাহিনী আজ কাঙ্খিত লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই সেনাবাহিনী চৌকষ ও পেশাদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
সেনাবাহিনী সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে স্পেশাল ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে এসআইএন্ডটিতে (স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিস) বিশেষ যুদ্ধশাখা গঠিত হয়। ১৯৮০ সালে বিশেষ যুদ্ধ শাখায় আর্মি কমান্ডো ও কাউন্টার ইন্সারজেন্সি কোর্স শুরু হয়। একই বছর স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইং সম্প্রসারিত হয়ে স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্কুল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৯ সালে এসআইএন্ডটির বিশেষ যুদ্ধ শাখায় বাংলাদেশে প্রথম প্যারা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ৩০ জুন ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সেনানিবাসে ১৯৯৩ সালের মে মাসে ব্যাটালিয়নের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স গঠনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১৫ সালের ১ জুন একটি পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ কওে ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। বর্তমানে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএম ইমরুল হাসান। তিনি বৃহস্পতিবার পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্যারেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।