নরসিংদী : গতকাল বুধবার রায়পুরার বাঁশবাড়িতে আওয়ামী লীগের দুই লাঠিয়াল বাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে দুটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের দৃশ্য : ছবি- দৈনিক সংগ্রাম থেকে নেয়া
বাংলার প্রতিদিন ডটকম,
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে তিনদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুটি লাঠিয়াল পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় চারটি গ্রামে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছে ১৫ জন।
গত শনিবার থেকে আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত রায়পুরার বাঁশগাড়ী, নিলক্ষ্যা, চরমধুয়া ও মির্জার চর ইউনিয়নে এসব ঘটনা ঘটে।
রায়পুরার চরাঞ্চলের আলোচিত ওই দুটি পক্ষের টেটাযুদ্ধে শামিল না হওয়ায় পাঁচ শতাধিক দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতা ও বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বাহিনীর সঙ্গে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহেদ সরকার বাহিনীর মধ্যে চলা এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পাশের ইউনিয়নগুলোতেও।
সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ও পাল্টা হামলা সংঘটিত হয়েছে মির্জারচর ও চরমধুয়া ইউনিয়নে। এতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামবাসী। চরমধুয়া নতুন বাজারের ১০টি দোকানে অগ্নিসংযোগসহ প্রায় ৪০টি দোকানে হামলা চালানো হয়।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাঁশগাড়ীতে গত ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা শাহেদ সরকার ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হকের সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। কিছুদিন আগে শাহেদ সরকার গ্রেপ্তার হয়ে এক মাসের বেশি কারাভোগ করে সম্প্রতি মুক্তি পায়। প্রায় ১০ দিন আগে দুই পক্ষের মীমাংসা করা হয়।
কিন্তু গত শনিবার রাতে মাঈন উদ্দিন নামের এক সমর্থকের বাড়িতে বসে শাহেদ সরকারের লাঠিয়ালরা গোপন সভা করছিলেন। এ সময় একটি পক্ষ অপপ্রচার চালায় যে মাঈন উদ্দিনের বাড়িঘর সিরাজুল হকের সমর্থকরা ঘিরে ফেলেছে, যেকোনো সময়ই হামলা হতে পারে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাত ৮টা থেকে শাহেদ সরকারের সমর্থকরা বটতলিকান্দি, বালুয়াকান্দি, চরমেঘনা ও দিঘলিয়াকান্দি ও নতুনবাজার এলাকায় ব্যাপকভাবে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে। এ সময় এলাকায় ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হলে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। এই সুযোগে নিয়ে শাহেদ সরকারের লাঠিয়ালরা লাঠিসোটা ও টেটা নিয়ে আশপাশের গ্রামের সিরাজুল হকের সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে প্রায় অর্ধশত বাড়ি এবং পাঁচটি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে। তারা টেটাযুদ্ধে অংশ নিতে মির্জার চর ও চরমধুয়া ইউনিয়নের লোকজনকে আহ্বান জানান। চরমধুয়ার লোকজন এ লড়াইয়ে অংশ নেননি। এতে উত্তেজিত হয়ে শাহেদ সরকারের পক্ষের লোকজন চরমধুয়ায় শিকদারবাড়ি এলাকায় হামলা ও লুটপাট চালায়। তারা অর্ধশতাধিক বাড়িসহ গ্রাম্য বাজারের প্রায় ৪০টি দোকানের মালামাল ও অর্থ লুট করে এবং আরো ১০টি দোকান লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় নারীরাও রেহাই পাননি। সন্ত্রাসীরা নারীদের কান ছিঁড়ে ও গলা থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়।
এই ঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোর্শেদা শিকদার বারবার রায়পুরা থানা পুলিশকে অবহিত করলেও পুলিশ কোনো ভূমিকা নেয়নি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি রায়পুরার এএসপি সার্কেলকে সারা দিন বহুবার কল দিয়েও গ্রামবাসীকে বাঁচাতে পুলিশ আনতে পারিনি। ঘটনা ঘটার পরে সোমবার বিকেল ৫টায় পুলিশ আসে। মূলত বাঁশগাড়ী, নিলক্ষা, চরমধুয়া ও মির্জারচরের কিছু লোক এই হামলার সঙ্গে জড়িত।’
চরমধুয়া নতুন বাজারের গ্রিন ইলেকট্রনিকসের স্বত্বাধিকারী রুবেল শিকদার বলেন, ‘আমার শোরুম থেকে টিভি, ফ্রিজ, ক্রোকারিজসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকার পণ্য লুট করে নিয়ে গেছে।’
শনিবার রাত ৯টার দিকে ঘরের কাজ করছিলেন গৃহবধূ জোছনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘হৈ-চৈ আর ককটেলের শব্দ শুনে আমরা ভয়ে ছোটাছুটি করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। এ সময় লোকজন আমাদের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে স্বর্ণালংকার, টাকা এমনকি ফ্যান পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। অনেক অনুরোধ করেও তাদের থামানো যায়নি।’
জোছনা তাঁর ছেঁড়া কান দেখিয়ে বলেন, ‘আমার কান থেকে তারা স্বর্ণের জিনিস টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যায়।’
হামলার শিকার গরুর খামারি আহসান শিকদার বলেন, ‘শনিবার গভীর রাতে পাঁচ-ছয়শ লোক দেশি অস্ত্র ও পিস্তল নিয়ে, ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আমার খামার থেকে ৪০টি গরু সন্ত্রাসীরা লুট করে নিয়ে যায়। তাদের পিস্তলের গুলিতে আহত হয়ে আমার দুই কর্মচারী নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।’
এই ঘটনায় চরমধুয়ার আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, ‘পাশের নিলক্ষ্যা ও বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন টেটাযুদ্ধপ্রবণ এলাকা। টেটাযুদ্ধে চরমধুয়াবাসীর সমর্থন ও অংশগ্রহণ চেয়েছিল তারা। আমরা অংশগ্রহণ না করায় এই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা।’ লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কমপক্ষে দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে মির্জারচর ইউনিয়নে শনিবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে রোববার গভীর রাত পর্যন্ত চলে উভয় পক্ষের হামলা ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ইউনিয়নের কান্দাপাড়া ও বালুচর গ্রামে তিন শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলা চলাকালে উভয় পক্ষের কমবেশি ১০ ব্যক্তি আহত হয়েছে। এঁদের মধ্যে ইকবাল (৩০) ও রজব আলী (২৮) নামের দুজনকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এঁদের দুজনই পরাজিত ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ফারুকুল ইসলামের সমর্থক বলে জানা গেছে।
ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত কমবেশি ২০০ পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তারা এখন চরাঞ্চলের খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, মির্জারচরে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী জাফর ইকবাল মানিক ও ফারুকুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব-কলহ চলে আসছে। নির্বাচনী এই বৈরিতাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মির্জারচরে ছোটবড় কমবেশি চারটি সংঘর্ষ হয়েছে। উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে রায়পুরা থানায় অন্তত নয়টি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর। সেদিনের সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ১০ জন। এর মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় পরাজিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ফারুকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী অপু। এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
গত শনিবার দুপুরে ফারুকের সমর্থকরা জনৈক মাঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে ৪২টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার পর চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা পাশের ইউনিয়ন বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, নিলক্ষা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার চরলাপাং থেকে কয়েকশ লাঠিয়াল ভাড়া করে এনে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মির্জারচর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া ও বালুচর গ্রামে হামলা চালায়। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী হামলা চলাকালে চেয়ারম্যান সমর্থক লাঠিয়াল বাহিনী তাণ্ডব চালিয়ে কমবেশি তিন শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফারুকের সমর্থকরা বিনা উসকানিতে শনিবার দুপুরে তাঁর সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ৪২টি বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গ্রামবাসী ফারুকের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে লাঠিয়ালরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়।
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনা তেমন কিছু না। সামান্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার রাত ১০টার দিকে দুই একটা দোকান ভাঙচুরের খবর আমরা পেয়েছি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ শফিউর রহমান বলেন, রোববার বিকেলে চরমধুয়া গ্রামে সহিংসতা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে।