হেলাল শেখ, ঢাকা ঃ-
দেশের পোশাক শিল্পের অস্থিরতা কাটছেই না। বেতন-ভাতা নিয়ে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব দিন দিন জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে। পোশাক খাতে এখন পযন্ত যতবার বেতন বেড়েছে, তার আগে প্রতিবারই আন্দোলন করতে হয়েছে শ্রমিকদের। শ্রমিক আন্দোলনে যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তখনই গঠন করা হয়েছে মজুরি বোর্ড, বাড়ানো হয়েছে বেতন। এবারও পরিস্থিতি সেই দিকেই যাচ্ছে। পোশাকশিল্পসহ ছয় শিল্পের শ্রমিকদের দাবি ন্যুনতম বেতন ১৬ হাজার করার, কিন্তু মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সর্বনিম্ন বেতন ১০ হাজার টাকার বেশি ওঠতে রাজি না।
এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সর্বনিম্ন মজুরি ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩শ টাকা নির্ধারণ করে পোশাক শ্রমিকদের বেতন কাঠামো কার্যকর করা হয়। তবে সরকারি চাকুরেদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার পর বেতন বাড়ানোর দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা তাদের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। আগেরবার মজুরি নির্ধারণের সময় পাঁচ বছর পর নতুন বেতন কাঠামো করার কথা বলা ছিল।
এই হিসাবে নতুন মজুরি কাঠামো চালু হতে আরও এক বছর সময় বাকি আছে। তবে সরকারের শেষ বছরে এই বিষয়টি নিয়ে যেন কোনো পক্ষ অস্থিরতা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সরকার আগেভাগেই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষের স্বার্থরক্ষায় শ্রম মন্ত্রণালায় বেতন কাঠামো পুন:নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করে চলতি বছরের শুরুতে। এ বোর্ড এখন পর্যন্ত দুইপক্ষের কারও সঙ্গেই কোনো আলোচনাই শুরু করেনি। বোর্ডে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সভা করেছে মাত্র একবার। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও শ্রমিক নেতা শামসুন্নাহার ভূইয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে গঠিত ৫ সদস্যের এই মজুরি বোর্ডকে আগামী নভেম্বরের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের ন্যুনতম বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে ।
দেশের তৈরি পোশাক (গার্মেন্টস), গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেট, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, বেকারি বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল এবং সিকিউরিটি সার্ভিস এই ছয় খাতের শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের নেতৃত্বে সর্বনিম্ন মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত অস্থায়ী কার্যালয়ে একটি সভাও করেছে নবগঠিত মজুরি বোর্ড। যদিও ওই সভায় বেতন বা মজুরি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এরই মধ্যে ছয়টি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন কতো হবে, কী কী সুবিধা শ্রমিকরা পেতে পারেন তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন এসব খাতের মালিক ও শ্র্রমিক প্রতিনিধিরা।
ছয় শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা সর্বনিম্ন বেতন দাবি করছেন ১৬ হাজার টাকা। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে গার্মেন্টস-টেক্সটাইল শ্রমিক ফোরামের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম সবুজ বলেন, সরকারি চাকরিতে সর্বনিম্ন বেতন এখন ১৭ হাজার ৩৬২ টাকা। আর পোশাক শ্রমিকদের সর্বন্ম্নি মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। আমরা বিভিন্নভাবে হিসেব করে দেখেছি, একজন শ্রমিকের পরিবারের সদস্যসহ মাসে সর্বনিম্ন ২৮ হাজার ৬২০ টাকা দরকার। তারপরও সার্বিক বিবেচনায় সরকার ও মালিকপক্ষের কাছে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করছি।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান, ভারতের শ্রমিকেরা যে মজুরি পায় বাংলাদেশে তার থেকে কম মজুরি পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটানের চাইতেও আমাদের দেশের মজুরি কম। অথচ মুনাফার দিকে থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। বাংলাদেশে ৪৩% মুনাফা হয় যা কম্বোডিয়াতে ৩১%, ভারতে ১১.০৮%, ইন্দোনেশিয়ায় ১০%, ভিয়েতনামে ৬.৫%, নেপালে ৪.৪০% ও চীনে ৩.২০%। এতো মুনাফা অর্জনের পর গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেয় না, তারা অব্যাহতভাবে শ্রমিকদের শ্রম আর মজুরি চুরির নতুন নতুন কৌশল বের করেন। ফলে শ্রমিক ও তার পরিবারের লোকজন বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, অর্ধাহারে-অনাহারে পুষ্টিহীনতায় জীবনযাপনে বাধ্য হন।
গার্মেন্টস কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সর্বনিম্ন বেতনের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকার ওপরে উঠতে রাজি নয়। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে চূড়ান্ত হবে সর্বনিম্ন বেতন কতো হবে। অবশ্যই যা ঘোষণা করা হবে তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাও থাকতে হবে। শিল্প সক্ষমতা এবং শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা এই দুটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা সে ধরনের একটি বেতন কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করছি।’
শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার নিম্নতম মজুরি ঘোষণা ও তা বাস্তবায়ন করতে চায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই। সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও সরকার গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড সূত্রে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। মজুরি বোর্ড আসন্ন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাসের আগেই, অর্থাৎ ৩০ জুনের মধ্যে তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে তা সরকারের কাছে জমা দিতে চাচ্ছে। তবে আপত্তি করছেন বিজিএমইএ নেতারা। তারা বলছেন, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাতে সময় আছে। তাহলে কেনও এই তড়িঘড়ি। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিলেই হবে।
দেশের এই ছয় শিল্পে নিয়োজিত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের সমর্থন আদায়ে সরকার এই কৌশল নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।