সাইফুর রহমান শামীম,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
অবশেষে ঢাকার কলাবাগানে ওভারব্রীজের নীচে আশ্রয় নেয়া মা
ফরিদা বেগম, তার স্বামী ও তিন সন্তানের পরিবারকে কুড়িগ্রাম
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নে পুর্ণবাসন করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত
উদ্যোগে শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় পরিবারটিকে সদর ইউএনও
আমিন আল পারভেজ, এনডিসি সুদীপ্ত কুমার সিংহ
পরিবারটিকে পাঁচগাছিতে নিয়ে যান। এর আগে বৃহস্পতিবার
রাতের কোচে ঢাকা থেকে কৃড়িগ্রামে নিয়ে আসার ব্যবস্থা
করেন ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাদুল আবেদীন
ডলার। সকাল সাড়ে ৭টায় পরিবারটি কুড়িগ্রাম শহরে পৌছলে
তাদেরকে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নিয়ে আসা হয়। এখানে
নিজেদের জীবনের অসহায়ত্বের কথা বলেন ফরিদা বেগম (৪০) ও তার
স্বামী আনছার আলী (৬০)।
ফরিদা ও তার স্বামী জানান, জেলার উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর মৌজার মরাকাটি গ্রামে বাড়ি
ছিল তাদের। ছিল ২ একর আবাদী জমি। দুধের ব্যবসা করে ভালই
চলছিল পরিবারটি। চরের মধ্যে প্রতিদিন ২ মন করে দুধ সংগ্রহ
করে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল মাড়িয়ে কুড়িগ্রাম শহরে
হোটেলগুলোতে দুধ সরবরাহ করত আনছার আলী। এভাবেই চলছিল
তাদের সংসার। কিন্তু ব্রহ্মপূত্র নদের ভাঙ্গনে ২০১৬ সালে একমাসের
মধ্যে বাড়ীঘর, আবাদি জমি সব নদের গর্ভে চলে যায়। গৃহহীন
হয়ে পরে এই পরিবারটি। তাদের সাথে দেড়শ পরিবারের ভিটেমাটি
নদের গর্ভে চলে যায়। শেষে আশ্রয় মেলে ইসলামপুরে জ্যাঠাত
ভাইয়ের গোয়ালঘরে। সেখানে একমাস থাকার পর বেঁচে থাকার
তাগিদে ঢাকায় চলে যান তারা।
ফরিদা বেগম জানান, জন্মের পর থেকেই অনেক কষ্টের জীবন আমার।
জন্মের আগে বাবা ও জন্মের ৭ দিনের মাথায় মা মারা যায়। তার পর
আশ্রয় মেলে চিন্নমুকুল নামে একটি এনজিওতে। সেখানে ৭
বছর থাকার পর ছিন্নমুকুল এনজিওটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবার
নানার বাড়িতে আশ্রয় নেই। কিছুদিন সেখানে থাকার পর বিয়ে
হয়। কিন্তু ৩ মাসের মাথায় ছাড়া ছাড়ি হয়। এর দুই বছর পর আনছার
আলীর সাথে বিয়ে হয়। তারও ডায়রিয়ায় বউ মারা যাওয়ায় আমার
সাথে দ্বিতীয় বিয়ে।
এই হল ভাঙন কবলিত আনছার আলী আর ফরিদা বেগমের জীবন
কাহিনী। অভাব-অনটন আর মাথা গোজার ঠাঁই না পেয়ে তারা গত
বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকায় পাড়ি দেয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে
শেষে আশ্রয় নেয় কলাবাগান ওভাব্রীজের নীচে। এখানে ধানমন্ডী
ক্লাবে দাড়োয়ান জামালের সহযোগিতায় মাঠের পাতা কুড়ার
কাজ করে দিনে আয় হয় দুশো থেকে আড়াইশ টাকা। সেই
অর্থেই চলছিল মানবেতর জীবন যাপন। মাঝখানে কাজটাও বন্ধ হযে
যায়। এসময় প্রায় না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল পরিবারটিকে।
সন্তানদের দু:খ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে নিজেই
ভিক্ষাবৃত্তি করতে বেড়িয়ে পরেন ফরিদা বেগম। তাদের তিন সন্তানের
মধ্যে আকলিমা (১১) একজন প্রতিবন্ধী, দ্বিতীয় কন্যা সন্তান
আখিতারা (৭) কে তারা গ্রামের বাড়িতে চাচীর কাছে রেখে যান।
একমাত্র ছেলে ফরিদুল (সাড়ে ৩) তাদের কাছে থাকে।
ফরিদা বেগম জানান, ঘটনার দিন দুসন্তানকে নিয়ে কলাবাগান
থেকে ল্যাব এইডের দিকে ভিক্ষা করতে বের হন। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে
বের হওয়ার ফলে ল্যাব এইডের কাছে অসুস্থ্য হয়ে ফুটপাতেই পরে
যান তিনি।
সেই স্মৃতি মনে করে ফরিদা বেগম জানান, বাচ্চা দুইটা না
খেয়ে ছিল। মা হয়ে কেমন করে বসে থাকা যায়। অসুস্থ্য শরীর নিয়া
ভিক্ষা করার জন্যে বের হয়েছিলাম। ঘোড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে
এক সময় চোখে অন্ধকার দেখতে থাকলে সেখানেই পড়ে যাই। মনে
হচ্ছিল সেদিনই শেষ দিন ছিল। বড় মেয়ে আমাকে ধরে থাকে। আর
ছোট ছেলে মাথায় পানি ঢালে। তারপর কি হয়েছিল তা আর জানা
নাই। পরেরদিন লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া কুড়িগ্রামের এই পরিবারটি নজরে আসলে
তাদের ভরন-পোষনের দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা
পারভীন। সন্তানসহ পুরো পরিবারটি কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে
আসলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেন সিভিল
সার্জন ডা: এসএম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি
মেডিকেল টিম। এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারটির খাবারের জন্য
প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবনসহ সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেন
কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম ।
কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা
কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন
সংগ্রাম করে আসছি। আমাদের ১২টি দাবির সাথে
কুড়িগ্রামের সকল ভূমিহীনদের পূণর্বাসনের দাবিটি সংযুক্ত
করা হয়েছে।
এসময় কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি এড. আহসান হাবীব
নীলু জানান, বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রতিবছর শত শত পরিবার
বাড়িভিটা হারাচ্ছে। নদী তীরবর্তী উন্মুক্ত এলাকায় নদী শাসনের
ব্যবস্থা না করায় বানভাসী ও গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে
চলেছে। ফরিদার মতো হাজারও মানুষ এখন বড় বড় শহরের পথে ঘাটে
মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব মানুষদের পুনরবাসন করা জরুরী।
সিভিল সার্জন ডা: এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, নিয়মিত
খাদ্য আর পুষ্টির অভাবে পুরো পরিবারটি স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে।
নিয়মিত খাবার ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র পেলে আস্তে আস্তে সব
স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল
পারভেজ জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন এ
পরিবারটির জন্য অস্থায়ী ভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নিশ্চিত করা হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। জেলা প্রশাসক মোছা:
সুলতানা পারভীনের নির্দেশে তাঁদের তিন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির
উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীন জানান, সরকার
প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের সকলের উচিৎ সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত
বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের
ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।