টি.আই সানি,গাজীপুর:
কালের বিবতর্নে হারিয়ে যাচ্ছে টাবুরে নৌকা সহ মালবাহী নৌকা। গাজীপুরের সকল উপজেলাতে এক সময় জনসাধারনের চলাচলের মাধ্যম ছিল নৌকা। কৃষক তার নিত্য প্রযোজনীয় কাজকর্ম সারতে নৌকা করে যাতয়াত করতেন। নদী বেষ্টিত গ্রাম গঞ্জে বিবাহ কাজে ব্যবহার হতো নৌকা। নৌকায় করে জামাই মেয়ে নিয়ে আসা সহ বিবাহের কাজ সম্পন্ন করতে বরযাত্রী আসতো নৌকায় করে।
কাপাসিয়া,বরমী, বড়মা, ত্রীমোহনী,রানীগঞ্জ,সালদহ্ গোসিংগা,নান্দিয়াসাংগুই, কাওরাইদ ব্যবসায়ীরা বড় বড় বন্দর থেকে নৌকায় করে তাদের ব্যবসার জন্য মালামাল আনা নেওয়া করতেন। মরিচচাপ,কপোতাক্ষ,খোলপেটুয়া নদীর সুবিশাল বুক জুড়ে ছিল নৌকার অবাধ বিচরণ। স্থানে স্থানে নদীর থৈ থৈ রূপালি পানির ধারে ছিলো খেয়া পারাপারের মুখরতা। ঘাটে ঘাটে সারাক্ষণ ছিল বৈঠা ও জলের শব্দ। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।
যান্ত্রিক সভ্যতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা ও নদী। পুরিয়ে গেছে মাঝিদের সোনালি দিন। একসময় বেতনা, কপোতাক্ষ,মরিচচাপ পাড়ের মানুষের সাথে নৌকার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। নদী তীরের বাসিন্দাদের জীবনের জন্য ছিল নৌকার নিবিড় প্রয়োজন। হাটবাজার যাতায়াত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠানেরও একমাত্র বাহন ছিল পালতোলা নৌকা। উন্নত সড়কপথ না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নৌকা ছিল একমাত্র ভরসা।
কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এসে সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দখলে চলে যাচ্ছে সবকিছুই। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্য নানা নামের বাহারি নৌকা। নদী থেকে নৌকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন নৌকার সাথে জড়িত মাঝি পরিবারের সদস্যরা। শীতলক্ষা,বুড়ি ঙ্গগা,দলাদীয়া মাটিকাটা,ধারত্রী,সালদহ্ নদীর খেয়া ঘাটের মাঝিরা এখন তাদের আদি পেশা পাল্টিয়ে ফেলছেন। মাছধরা, গাছ কাটা, ধান কাটাসহ দৈনিক শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা।
একসময় শীতলক্ষ,বুড়িঙ্গগা,দলাদীয়া মাটিকাটা,ধারত্রী,সালদহ্ নদীকে ঘিরেই হাজারো মানুষের জীবনজীবিকা, স্বপ্ন, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা। একসময় নদীর দুই পাড়ে কয়েক শ’ ঘাট ছিল। এসব ঘাট দিয়ে নৌকায় চড়ে পারাপার হত যাত্রীরা। এখন সেই দিন আর নেই। গাজীপুরের সিমীত কিছু জায়গায় নৌ পারাপার এখনো কিছুটা সচল থাকলেও অনেক মাঝিরা পেশা পাল্টাচ্ছেন। অধিকাংশ নৌকার মাঝি পেশা পাল্টিয়ে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এই সব কথা বলেন বরমী শীতলক্ষা খেয়া ঘাটের মাঝি শ্রী শ্রী পরিমল চন্দ্র বর্মন
এখন এসব এলাকায় খেয়া পারাপার নেই বললেই চলে। কাপাসিয়া,বরমী, বড়মা, ত্রীমোহনী,রানীগঞ্জ,সালদহ্ গোসিংগা,নান্দিয়াসাংগুই, কাওরাইদ,কালিয়াকৈর,ফুলবাড়িয়া নদী থেকে কয়েকশত প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় সেখানেও টিকে থাকতে পারছেন না তারা। নদীর খেয়াঘাটের মাঝিদের এখন চরম দুর্দিন চলছে। ছোটবড় খেয়াঘাট সহ নদীতে নৌকা চলাতে না পারায় কয়েক শতাধিক মাঝি পরিবারে চলছে অভাব অনটন। কিছু ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মালামাল পরিবহনেও এখন তাদের ডাক পড়ে না। আগের মতো তাদের নৌকায় চড়ে কেউ আর নদী পারাপার হচ্ছে না। তবুও যাত্রীর আশায় কেউ কেউ নদীঘাটে অলস সময় পার করছেন।
বরমী খেয়া ঘাটের মাঝি পরিমল চন্দ্র বর্মন জানান, সে চল্লিশ বছর যাবৎ এই নদীতে নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করছে। কেউ মন চায়লে টাকা দেয় আবার কেউ কেউ না দিয়েও চলে যায়। নদীর নাব্যতা হারানোর নদী ছোট হয়ে গেছে এবং সর্বত্র ব্রীজ হয়ে যাওয়ায় নৌকার কদর কমে গেছে। অনেক স্থানে ব্রিজ হওয়ায় এখন আর তেমন নৌকার ভাড়া নেই। আয় উপার্জন আগের মতো আর হয় না। অন্যদিকে বেশির ভাগ মাঝি মহাজনদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে নদীতে চালাতে হয়। মালিকরা নৌকা ভাড়া আগের তুলনায় অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এখন ঘাট মালিকদের টোল প্রদান ও মালিকের নৌকা ভাড়া প্রতিদিন পরিশোধ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
রুটি রুজির তাগিদে মাঝিরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রোদ বৃষ্টি ঝড়, ঝড়–তুফান উপেক্ষা করে নৌকা চালিয়ে যা উপার্জন করে তার বেশির ভাগই নৌকা মালিক ও ঘাট মালিকদের পাওনা বাবদ পরিশোধ করতে হয়। এতে অবশিষ্ট আয়ের অংশ দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য।
বরমী বাজার বহুদিন আগের ব্যবসায়ী গোপাল দাস বলেন,মাঝিদের অনেকেই এ পেশায় অনেক বছর যাবত জড়িয়ে রয়েছেন। তাদের উপায় নেই জেনেও অনেকে এই পেশা ছাড়তে পারছেন না। আবার জীবিকার তাগিদে অনেকে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। মাঝিদের মধ্যে অনেক পরিবার ভূমিহীন। তাছাড়া এদের কোন ঋণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
কাওরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মন্ডল বলেন, নৌকা ছিল এই এলাকার আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা ও সড়কপথের আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকার কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।