সৈয়দ জিয়াউর রহমান, বাংলা কণ্ঠ সাংবাদিকতার একজন কর্ণধার এবং ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের বিশিষ্ট সাবেক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গত ৩১ জানুয়ারি মারা গেলেন। জিয়াউর রহমান সাংবাদিকতায় কাজ করেছেন ছয় দশকের কাছাকাছি, বাংলাদেশে তিন দশক এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি কণ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি অবসর নিলে ভয়েস অব আমেরিকার শ্রোতারা তাঁর কণ্ঠ না শুনতে পারলেও আমরা যাঁরা তাঁর গুণগ্রাহী, তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেতাম বিভিন্ন জায়গায়—কফির আড্ডায়, কবিতার আসরে কিংবা অন্য আসরে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর আর শুনতে পারব না কোনো দিন, তিনি চলে গেলেন কথা না বলার আসরে চিরদিনের জন্য।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় আকস্মিকভাবে ১৯৮৩ সালে। তখন আমি ওয়াশিংটন এলাকায় চাকরির সুবাদে আসি। যদিও জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সাংবাদিক জগতে পরিচিত নাম এবং ওয়াশিংটন এলাকার বাঙালি মহলে তিনি সুপরিচিত—আমি তাঁকে চিনলাম একজন মানুষ হিসেবে। তিনি পরিচিত হওয়ার সময় কখনোই বলতেন না তাঁর সাংবাদিতায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা, কিংবা ভয়েস অব আমেরিকায় তাঁর কাজের কথা। তিনি শুধু পরিচয় দিলেন আমাদের এক বন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে। এটাই ছিল জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্ব, এটাই ছিল তাঁর অমায়িকতা, তাঁর পরিচয়। তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে পরিচিত ছিলেন একজন বন্ধু হিসেবে, একজন সহায়ক হিসেবে, একজন নির্ভরশীল মানুষ হিসেবে।
দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে তিনি বহু দেশের বহু রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অহম ছিল না। তিনি এগুলোকে তাঁর পেশাগত জীবনের একটি অংশ হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর প্রশ্নে কোনো কোনো নেতা বিব্রত বা অসন্তুষ্ট হলেও তাঁর কাজের জন্য পুনর্বার তাঁকে সাক্ষাৎকার দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি। তাঁর কাজ প্রমাণ করেছে, তিনি ছিলেন একজন নিরপেক্ষ, স্বাধীনচিত্ত এবং সাহসী সাংবাদিক।
জিয়াউর রহমানের দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবন নিয়ে আলোচনার জন্য দরকার আরও সময় এবং আরও তথ্য, যা আমার কাছে নেই। আমার কাছে আছে শুধু তাঁর ওয়াশিংটন-জীবনের কিছু স্মৃতি আর তাঁর আকর্ষণীয় বার্তালাপ, যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতে পারত আর ছিল তাঁর অসাধারণ স্মরণশক্তি। পঞ্চাশের দশকে তাঁর সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে যেসব ছোট ছোট ঘটনা ঘটেছিল, তা তিনি যেকোনো আসরে অনায়াসে বলতে পারতেন। বলতেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। যে সময়ে সাংবাদিকতাকে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি পেশা হিসেবে নিতে চাইতেন না, সে সময় তিনি পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি আজীবন এ পেশায় ছিলেন এবং নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন।
জিয়াউর রহমান শুধু তাঁর সাংবাদিতার কথা বলেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন না, করতেন তাঁর রসবোধ দিয়েও। দুটি উদাহরণ দিয়ে আমার ছোট লেখাটি শেষ করছি। দুটি ঘটনা জিয়াউর রহমান বর্ণিত এবং তা নিজেকে নিয়ে।
প্রথম ঘটনা: তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার সংবাদ হঠাৎ যখন ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা শুনলেন, তিনি বললেন, না না, এ কীভাবে হয়। আমাদের জিয়াউর রহমান একজন বড় ভালো মানুষ, তাঁকে কেন লোকে হত্যা করবে?
দ্বিতীয় ঘটনা: সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে একজন মন্ত্রী আমাদের জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা আপনার নাম কি আমাদের প্রেসিডেন্টের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল?’ জিয়াউর রহমান হেসে বললেন, ‘মন্ত্রী সাহেব, আমার জন্ম আপনাদের প্রেসিডেন্টের পাঁচ বছর আগে। আপনি নিজেই চিন্তা করেন, কার নামে কার নাম রাখা হয়েছে।’
এই ছিলেন আমাদের প্রয়াত সাংবাদিক জিয়াউর রহমান। তাঁর মতো সাংবাদিক আর হবে কি না, সন্দেহ আছে।