অনেক চেষ্টার পর তাঁকে পাওয়া গেল। ফোন ধরতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘একটা মিটিংয়ে আছি, পাঁচ মিনিট পর কথা বলছি।’ ৫ মিনিট যায়, ১০ মিনিট যায়, ২০ মিনিট…আশিকুর রহমানকে কি পেয়েও হারিয়ে ফেলা হলো!
আশিকুর রহমান এক রহস্যময় নাম হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। যুব বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ১১ অধিনায়কের ১০ জনই এখনো জড়িয়ে আছেন ক্রিকেটের সঙ্গে। তাঁদের কেউ কেউ এখন দেশের ক্রিকেটের বড় তারকাও। কেউ আবার ক্রিকেট ছেড়ে জড়িয়েছেন বোর্ডের সঙ্গে। কিন্তু দেশের মাঠে হওয়া ২০০৪ যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া সেই আশিক কোথায়? কী করেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁর একসময়ের সতীর্থরাও ঠিকঠাক জানাতে পারলেন না। ২০০৪ যুব বিশ্বকাপ খেলা আফতাব আহমেদ বললেন, ‘ক্রিকেট ছাড়ার পর থেকেই সে গায়েব! কোথায় যে হারাল, বলতে পারি না। আমাদের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।’ সেই টুর্নামেন্ট খেলা নাফিস ইকবালও বললেন একই কথা, ‘ও এখন কী করে, কোথায় আছে, কিছুই জানা নেই।’
আশিকের সন্ধানে কাল সাবেক-বর্তমান অনেক খেলোয়াড়ের শরণ নেওয়া হলো। বেশির ভাগই বললেন, তিনি এখন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে মিলল তাঁর নম্বর। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ, পরে সরাসরি কল দিতেই জানা গেল, ঢাকাতেই আছেন। কাজ করেন একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে। ফোনটা যখন ধরলেন, তখন তিনি মিটিংয়ে। সৌজন্যের খাতিরেই বললেন, ‘৫ মিনিট পর ফোন দিচ্ছি’। ৫ মিনিট গড়াল ৪০ মিনিটে। অবশেষে তিনিই ফোন করলেন। সাংবাদিক পরিচয় জেনে শুরুতে জানিয়ে দিলেন, ক্রিকেট-সংক্রান্ত কোনো কথা বলতে তিনি আগ্রহী নন।
ক্রিকেট আশিকের জীবনে অতীত। অতীতকে তিনি কিছুতেই বর্তমানে আনতে চান না। কেন চান না, সেটিও বিস্তারিত বলতে চান না। শুধু এতটুকুই বললেন, ‘একসময় নিজেকে ক্রিকেটার হিসেবেই দেখেছি। পরে মনে হলো, এটা আমার পথ নয়। আমার পথ পরিবর্তন করা উচিত। শুধু অর্থ উপার্জন নয়; সম্মান-গর্বের জন্য ক্রিকেট খেলেছি। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার গর্বটা অনুভব করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যখন মনে হয়েছে আমার আর দেশের প্রতিনিধিত্ব করা হবে না, তখন মনে হয়েছে এটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।’
তাই বলে একেবারেই নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলা কেন? আশিক রহস্যের হাসি হাসেন, ‘নিজেকে ইচ্ছে করেই অদৃশ্য করে ফেলেছি। একবারেই ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি না। বলতে ভালো লাগে না। গুগলে খুঁজলেও সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে আমাকে নিয়ে তেমন কিছু পাবেন না। এখন কিছু না করেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ পরিচিত হওয়া যায়। আমি সেটিও করিনি।’
ক্রিকেটে মাঠে যেমন খেলতে হয়। মাঠের বাইরেও তেমন। আশিকের দাবি, তিনি মাঠের বাইরে নাকি কখনোই ভালো ছিলেন না। ভালো তিনি হতেও চাননি। আশিক নিজেকে সেই শ্রেণিতে রাখতে চান যাঁরা ‘যদি’, ‘কিন্তু’র বাধা পেরোতে চান না কিছুতেই। পেরোতে চান না আরও অনেক অক্রিকেটীয় প্রতিবন্ধিকতা।
কোন রাগ, ক্ষোভ, অভিমান বুকে নিয়ে আশিক তাঁর প্রিয় খেলাটার সঙ্গে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদই ঘটিয়ে ফেললেন, সে ব্যাখ্যায় যেতেই চাইলেন না। এখানে ‘চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ’টা আক্ষরিক অর্থেই। দর্শক হিসেবেও তাঁর কোনো যোগ নেই ক্রিকেটের সঙ্গে। এই যে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ বাংলাদেশ জিতল, ফাইনালটা নাকি দেখা হয়নি! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুটা সক্রিয় বলে হয়তো চোখে পড়েছে। কেন ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না, বলতে ভালো লাগে না, সেটি বোঝাতে একটি বাস্তবতা তুলে ধরলেন আশিক, ‘আজ যারা বিশ্বকাপ জিতল, আরেকটা বিশ্বকাপ আসার আগে এদের কেউ কেউ স্মৃতির আড়ালে চলে যাবে। আরও কিছু বিশ্বকাপ যাওয়ার পর তখন হয়তো আপনারাই খুঁজবেন কোনো কোনো ক্রিকেটারকে। বলবেন, আপনি তো ওই দলে ছিলেন।’
সাধারণ মানুষ যেভাবে ক্রিকেট দেখে, আলোচনা করে, আশিক সেভাবে দেখতে চান না। হয়তো অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছেন বলে কী এক অভিমানে খেলাটার সঙ্গে তৈরি হয়েছে তাঁর যোজন যোজন দূরত্ব। ক্রিকেটের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলেও আশিকের প্রিয় ক্রিকেটারের তালিকায় এখনো আছেন মুশফিকুর রহিম। মুশফিককে চেনেন বিকেএসপি থেকেই। আশিক ছিলেন মুশফিকের দুই বছরের সিনিয়র। বিকেএসপিতে পড়া সমসাময়িক ক্রিকেটাররাই শুধু নন, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যাঁদের সঙ্গে খেলেছেন, তাঁরা কতজনই তো জাতীয় দলে এসেছেন। কিন্তু আশিক হারিয়ে গেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের পর থেকেই। সেই অদৃশ্য অধিনায়ক ক্রিকেটে দৃশ্যমান হতে চান না আর কখনোই।