বিপত্তিটা শুরু হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে।
রিয়াল মাদ্রিদের পর প্রথম ক্লাব হিসেবে টানা দুই বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বপ্নে বিভোর লিভারপুল দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগে ধাক্কা খেয়েছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে। নেমে এসেছে বাস্তবতার জমিনে। ডিয়েগো সিমিওনের আঁটসাঁট পরিকল্পনায় হাঁসফাঁস করতে থাকা মোহাম্মদ সালাহ-সাদিও মানে-রবার্তো ফিরমিনোরা ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানো থেকে হেরে এসেছেন ১-০ গোলে। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে হলে ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ডে অ্যাটলেটিকোকে অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে হারাতে হবে। কাজটা যথেষ্ট কঠিন। ফর্মহীন লিভারপুলের জন্য তো আরও কঠিন।
এরপর গোটা মৌসুমে লিগে অপরাজিত থাকা লিভারপুল গত সপ্তাহে হুট করে হেরে বসে ওয়াটফোর্ডের কাছে। তাও যেমন-তেমন হার নয়। রীতিমতো ৩-০ গোলে পর্যুদস্ত হয়েছে তারা। ফলে ভেঙে গেছে গোটা মৌসুম অপরাজিত থেকে লিগ জয়ের স্বপ্ন। লিগে টানা ৪৪ ম্যাচ জেতার পর হারল লিভারপুল। এর কয়েক দিন পরই চেলসি বিদায় করে দিল এফএ কাপ থেকে।
ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। হয়েছেটা কী লিভারপুলের?
চোট সমস্যা? ফর্মহীনতা? উপযুক্ত খেলোয়াড়ের অভাব? জিততে জিততে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া?
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে প্রত্যেকটা কারণই বলা যায় উত্তর হিসেবে।
মৌসুমে লিভারপুল অপ্রতিরোধ্য থাকায় যে বিষয়টি নজরে আসেনি, সেটা হলো দলটার চোট সমস্যা। মৌসুমের শুরুতে মাংসপেশির চোটে পড়ে ১১ ম্যাচ মাঠের বাইরে ছিলেন মূল গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। তখন কাজ চালিয়ে গেছেন দলে নতুন আসা স্প্যানিশ গোলরক্ষক আদ্রিয়ান। এমনকি গত সপ্তাহে অনুশীলন করতে গিয়ে আবারও চোটে পড়েছেন ব্রাজিলের মূল গোলরক্ষক। ফলে বোর্নমাউথের বিপক্ষে আজকের ম্যাচ ও অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগে যে তাঁকে দেখা যাবে না, এটা নিশ্চিত। লিগামেন্টে চোটের কারণে প্রায় এক বছর ধরে মাঠের বাইরে রাইটব্যাক নাথানিয়েল ক্লাইন। যে কারণে চাইলেও মূল রাইটব্যাক ট্রেন্ট-আলেক্সান্ডার আরনল্ডকে বিশ্রাম দিতে পারছেন না কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। একই ধরনের চোটে পড়ে ডিসেম্বর থেকে ১৩টি ম্যাচ খেলতে পারেননি ব্রাজিলের মিডফিল্ডার ফাবিনহো।
একই সময়ে পেশির চোটে পড়ে ১১ ম্যাচ মাঠের বাইরে ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার সেন্টারব্যাক দেয়ান লভরেন। একই চোটে পড়ে ১১ ম্যাচ খেলা হয়নি সুইস উইঙ্গার শাকিরিরও। গত জানুয়ারিতে চোটে পড়ে সাত ম্যাচ মাঠের বাইরে ছিলেন মিডফিল্ডার জেমস মিলনার। কুঁচকি ও পেশির চোটে মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ ম্যাচে খেলার জন্য ফিট ছিলেন না গিনির মিডফিল্ডার নবি কেইতা। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে পড়ে কিছুদিন আগেও মাঠের বাইরে ছিলেন সাদিও মানে, খেলতে পারেননি চারটি ম্যাচ। গত ফেব্রুয়ারিতে একই চোটে পড়েছেন দলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন, এর মধ্যেই পাঁচ ম্যাচে লিভারপুল তাঁকে ছাড়া খেলেছে। আরও কয়েকটা ম্যাচে হেন্ডারসনের অনুপস্থিতি থাকতে পারে।
গোড়ালি ও মাথার আলাদা দুটি চোটে পড়ে পাঁচটি ম্যাচ বাইরে বসে থেকে দেখেছেন মিডফিল্ডার অ্যালেক্স অক্সলেড-চেম্বারলিন। গোড়ালির চোট ভুগিয়েছে গত চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে গোল করা স্ট্রাইকার ডিভক অরিগিকেও। খেলতে দেয়নি পাঁচ ম্যাচে। হাঁটুর চোটে পড়ে ২০ ম্যাচ মাঠের বাইরে বসে ছিলেন ক্যামেরুনের সেন্টারব্যাক জল মাতিপও।
অর্থাৎ মূল দলে যারা নিয়মিত খেলেন, তাঁদের মধ্যে চোটহীন থাকতে পেরেছেন শুধু সালাহ, ফিরমিনো, আলেক্সান্ডার-আরনল্ড, জর্জিনিও ভাইনালদাম ও ভার্জিল ফন ডাইক। মূল দলের অন্যান্য খেলোয়াড় সহ বেঞ্চে থাকা কিছু খেলোয়াড়দের নিয়মিত চোটের কারণে আনকোরা খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে হয়েছে ইয়ুর্গেন ক্লপকে। এদের মধ্যে রয়েছেন কার্টিস জোন্স, নিকো উইলিয়ামস, হার্ভি এলিয়ট প্রমুখ।
চোট সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফর্মহীনতাও। চোট থেকে ফিরে এসে সেই আগের মতো ফর্মে নেই ফাবিনহো, অরিগি, অক্সলেড-চেম্বারলিনের মতো তারকারা। সবচেয়ে ভোগাচ্ছে ফাবিনহোর ফর্মে না থাকা। ফাবিনহো ফর্মে না থাকার কারণে রক্ষণভাগে অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে জো গোমেজ, জল মাতিপ ও ভার্জিল ফন ডাইকদের। চেলসি ও ওয়াটফোর্ডের বিপক্ষে হার দুটিতে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু লেগেছে ফাবিনহোর পারফরম্যান্স।
খেলোয়াড়দের নিয়মিত চোটের কারণে নজরে পড়েছে উপযুক্ত বিকল্প খেলোয়াড় না থাকার বিষয়টা। দুই ফুলব্যাক রবার্টসন-আরনল্ডের বিকল্প দলে নেই বললেই চলে। আক্রমণ ‘ত্রয়ী’ সালাহ-মানে-ফিরমিনোর কেউ একজন চোটে পড়লে যাদের নামানো হয়, তাঁদের মান আর সালাহদের মানের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। যে কারণে আগামী মৌসুমে জার্মান স্ট্রাইকার তিমো ভেরনারকে দলে আনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা শুরু করে দিয়েছেন ক্লপ।
এ সব কারণগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত জিততে জিততে ক্লান্ত হয়ে পড়ার বিষয়টা তো আছেই।
চার ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই হার এ কথাগুলোকেই প্রমাণ করে যেন। আজ লিভারপুলের সামনে সুযোগ হারের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার। তারা কী পারবে? আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বোর্নমাউথের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে খেলতে নামবে লিভারপুল। জিতলে লিগ শিরোপা থেকে আর মাত্র তিন জয় দূরে থাকবে তারা। হারলে পাঁচ দিন পর অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে মাঠে নামবে তলানিতে ঠেকা আত্মবিশ্বাস নিয়ে।