জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত শুক্রবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন বাহরাইনফেরত এক প্রবাসী। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাঁর শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার প্রায় সব লক্ষণ দেখতে পান চিকিৎসকেরা। এ খবর রোববার দুপুরে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ওয়ার্ডে থাকা অন্য রোগীরা। তাঁর শয্যার পাশ থেকে সরে যান অন্য রোগীসহ দায়িত্বরত নার্সরাও। আর এই রোগীকে কোথায় রাখা হবে, তাঁর চিকিৎসা কীভাবে শুরু হবে, সে বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে চিকিৎসকেরা জড়ো হন হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে।
রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে যখন আলাপ-আলোচনা চলছিল, ততক্ষণে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান ওই রোগী। পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি হাসপাতালের পুরুষ ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। তাঁকে অন্য রোগীদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখতে না পারার কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো করোনা চিকিৎসার প্রস্তুতিই শুরু করেনি। যেসব চিকিৎসক ও নার্স করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা করবেন, তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী বা পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টও (পিপিই) এই হাসপাতালে নেই।
অথচ করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে গত ২৭ জানুয়ারি দেশের সব সরকারি হাসপাতালে অনতিবিলম্বে ‘আইসোলেশন ইউনিট’ (সংক্রামক রোগীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা) খোলার নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশের আটটি বিভাগের সব জেলা সদর এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই ইউনিট খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। দেড় মাস আগে এই নির্দেশনা দেওয়া হলেও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এখনো আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়নি।
রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়ার কক্ষে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সেখানে তখন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, নার্সও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পরিচালককে জানান, পুরুষ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের একজন রোগীর মধ্যে করোনাভাইরাস আক্রান্তের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর হাসপাতালের পরিচালক ওই রোগীকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের জন্য ‘রেফারেন্স’ (সংরক্ষিত) হাসপাতাল হিসেবে নির্দিষ্ট করা উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করেন। পরে তিনি ওই রোগীকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানোর উদ্যোগ নেন। এ ছাড়া ফোনে যোগাযোগ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং আইইডিসিআরের পরিচালকের সঙ্গে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার একপর্যায়ে উত্তম বড়ুয়াকে বলতে শোনা যায়, তাঁর হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়নি। সন্দেহভাজন রোগী অন্য সাধারণ রোগীদের মধ্যেই আছেন। ফোনটি রাখার পর তিনি (উত্তম বড়ুয়া) আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ওই রোগীকে আইইডিসিআরে নেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। কথা শেষ করার পর তিনি সহকর্মীদের বলেন, আইইডিসিআরের একটি দল এখনই হাসপাতালে আসবে। এরপর তাঁর কক্ষে জড়ো হওয়া চিকিৎসক, নার্সরা বের হয়ে যান।
রোববার বেলা দেড়টার দিকে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে ওই রোগীর বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তম বড়ুয়া বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, আইইডিসিআরের পরিচালকের সঙ্গে ওই রোগী বিষয়ে কথা বলেছি। নিজেরা মিটিং করছিলাম। এর মধ্যে ওই রোগী পালিয়ে গেছেন।’
পরে হাসপাতালের পুরুষ ৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ওই রোগী যে শয্যায় ভর্তি ছিলেন, সেটি ফাঁকা। কর্তব্যরত নার্স জানান, ওই ব্যক্তির বয়স ৪০ বছর, বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালের নিবন্ধন বইয়ে রোগী একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়েছেন। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। নার্স জানান, গত ১৮ জানুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন থেকে দেশে ফেরত আসেন ওই ব্যক্তি। তবে তখন তাঁর জ্বর ছিল না বলে চিকিৎসকদের জানিয়েছেন।
করোনা সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রস্তুতি কতটা তা নিয়ে ১০ মার্চ ‘প্রস্তুতি শুরু করতেই দেড় মাস পার’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ১৫ নম্বর ডেঙ্গু ওয়ার্ডের (পুরুষ) অর্ধেক অংশজুড়ে এবং নতুন ভবনের কেবিন ব্লকটি করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে করোনা ইউনিট চালু করা হবে।
এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আইসোলেশন ইউনিট করার জন্য যে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে দরজা-জানালা কিছু নেই। গণপূর্ত অধিদপ্তরের লোকজন কাজ শুরু করেছেন। পুরো প্রস্তুতি শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক লাগবে।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ রোববার রাতে মুঠেফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আজই জানলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়নি। পরিচালকের কাছে জানতে চাইলাম, সন্দেহভাজন রোগীকে আলাদা রাখেননি কেন? দ্রুত করোনা ইউনিট তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ওই রোগী যদি করোনভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকেন, তাহলে তা অন্যদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। ওই রোগীকে দ্রুত খুঁজে বের করা দরকার।