নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ভিডিওটির একটি কপি সিডি আকারে বা পেনড্রাইভে করে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকলে তা সমাজে প্রভাব ফেলবে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। একারণেই এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণ করা প্রয়োজন।
একইসঙ্গে ওই ঘটনায় করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিতা নারী ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর এসপির প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালত মোট ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া ওই ঘটনায় নির্যাতিতা নারীর জবানবন্দি গ্রহণে পুলিশের কোনো অবহেলা ছিল কি না তা অনুসন্ধানে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন আদালত। কমিটিতে সদস্য হিসেবে নোয়াখালী জেলা সমাজ সেবা অফিসার এবং চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের অধ্যক্ষকে রাখা হয়েছে। এ কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটিতে সবধরণের সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে লিখিত প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ আদেশ দিয়েছেন। আগামী ২৯ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত। ওই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও আব্দুল্লাহ আল মামুন নজরে আনার পর আদালত আদেশ দেন। এ বিষয়ে আদালতে বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এএম আমিনউদ্দিন, সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান, জামিউল হক ফয়সাল, রাশিদা চৌধুরী নিলু, তানজীম আল ইসলাম প্রমূখ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী।
অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেছেন আদালত। রুলে ওই নারীকে রক্ষায় এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অবহেলার কারণে বেগমগঞ্জ থানার ওসি এবং ওই থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন এবং ডাক ও টেলি যোগাযোগ সচিব, বিটিআরসি চেয়ারম্যান, নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক, বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালত বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এই ঘটনার ৩২ দিন পর যখন ভিডিও ভাইরাল হলো তখন পুলিশ তৎপর হয়েছে। এর আগে তারা কি করেছে? এই ভিডিও যদি ভাইরাল না হতো তাহলেতো পুলিশ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো না। ঘটনা সবার চোখের আড়ালেই থেকে যেতো। একইসঙ্গে এ ঘটনায় কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা নারী সংগঠন প্রতিকারের জন্য আদালতের শরনাপন্ন হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আমরা আশাহত হয়েছি যে অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্টের মতো সংগঠন বা কোনো নারী সংগঠন এগিয়ে আসেনি।
ওই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আজ সকালে আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। এসময় আদালত তাকে একটি লিখিত আবেদন দিতে বলেন। এবং বেলা আড়াইটায় শুনানির সময় নির্ধারণ করেন। পরে নির্ধারিত সময়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণের আবেদন জানান। তারা বলেন, এটা একটি জনস্বার্থমূলক বিষয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রয়ে গেছে। এটা থাকলে সমাজে প্রভাব ফেলবে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাই এটা অপসারণ করা দরকার। তবে ভিডিওটি সাক্ষ্য হিসেবে সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা চাচ্ছি। এছাড়া এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চাচ্ছি। এসময় শুনানিতে অংশ নেন অপরাপর আইনজীবীরা।
শুনানিতে এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ওই নারীর সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা জঘন্যতম অপরাধ। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। আমি মনে করি, মামলাটি আপনাদের (হাইকোর্ট) পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। তিনি বলেন, বিটিআরসির প্রতি একটি নির্দেশনা থাকা দরকার, যাতে এ ধরণের কোনো ভিডিও কেউ আপলোড করতে না পারে।
রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমি মনে করি এইসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে মনোবিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে দেখা উচিত কেন এ ধরনের একের পর এক ঘটনা ঘটছে। তাই এটাকে বিচারিক নজরে রাখা প্রয়োজন।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, এধরনের ঘটনা এখন সারা দেশেই ঘটছে। কিন্তু ঘটনায় জড়িতরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব কারনে কোনো কোনো ঘটনায় আইন শৃংখলা বাহিনী তৎপর হচ্ছে না। তাই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
রাশিদা চৌধুরী নিলু নিজেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সন্তান উল্লেখ করে বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ খুবই তৎপর। এসময় আদালত বলেন, পুলিশ কখন তৎপর হয়েছে? ৩২ দিন পর যখন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এর আগে পুলিশ কি করেছে? এসময় রাশিদা চৌধুরী নিলু আবার বলেন, এখন থেকে বিচারের দিকটি আপনারা ফলোআপে রাখলে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক একজন নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করছে। তাদের একজন পা দিয়ে ওই নারীর মুখ চেপে ধরেছে। বার বার আকুতি জানানোর পরও তার ওপর নির্যাতন থামেনি।
গত ২ সেপ্টেম্বরের এই ঘটনার ভিডিও রবিবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওই নারীকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয় স্থানীয় পুলিশ। পাশাপাশি এ ঘটনায় নির্যাতিতা নারী একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন রাত ৯টার দিকে আসামিরা তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে এবং ওই নারীর স্বামীকে মারধর করে পাশের আরেকটি ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখে। এরপর আসামিরা তাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এতে বাধা দিলে আসামিরা তাকে নির্যাতন করে এবং মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ভিডিও করে। ওই নারীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়। এরপর তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে জেলা শহরের মাইজদীতে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও আসামিরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ‘কুপ্রস্তাব’ দেয়। তাতে রাজি না হলে সেই রাতের ভিডিও তারা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।