ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ বলিভিয়াকে নিয়ে যতটা না কথা হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি কথা হচ্ছিল ভেন্যু নিয়ে। আলোচনার টেবিল সরগরম করে রেখেছিল লা পাজ। আর রাখবে না-ই বা কেন? বিশ্বের কোন মাঠে খেলতে গেলে আর্জেন্টিনা লা পাজের চেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে? গবেষণার বিষয়ই বটে। দেড় দশক ধরে এই মাঠে জয়হীন থেকেছিল তাঁরা। অন্যান্য ম্যাচের ফলাফল আর যা-ই হোক না কেন, এই পনেরো বছরে নিজেদের মাঠে আর্জেন্টিনার ওপর বলিভিয়ার ‘মস্তানি’ ছিল চিরন্তন। অবশেষে ১৫ বছর পর সে ‘গেরো’ কাটাতে পেরেছেন মেসিরা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে বলিভিয়ার মাঠে গিয়ে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে এসেছে আর্জেন্টিনা।
নিজেদের মাঠে বলিভিয়ার একেক খেলোয়াড় যে মেসি, রোনালদো, পেলে, ম্যারাডোনা, মালদিনি হয়ে যান, তা কিন্তু নয়। বলিভিয়ার এই দাপটের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান দেশটার আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের। লা পাজের এস্তাদিও এর্নান্দেস সাইলেস ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত, ঠিকঠাক হিসাব করলে ৩ হাজার ৬৩৭ মিটার বা ১১ হাজার ৯৩২ ফুট উঁচুতে। বলিভিয়ার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা খেলোয়াড় ছাড়া অন্যদের পক্ষে এই উচ্চতা জয় করা এক রকম দুঃসাধ্যই বলা চলে। ঠিকঠাক নিশ্বাসই যেখানে নেওয়া কষ্ট, সেখানে ভালো ফুটবল খেলে দাপট দেখানো তো অনেক দূরের ব্যাপার। মাঠে বলের বাউন্সও বোঝা যায় না। এই মাঠে বলিভিয়াকে টেক্কা দেওয়ার একমাত্র উপায় শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলটা কবে শারীরিকভাবে দৈত্যসম দল ছিল! ১৫ বছরের আক্ষেপটা তাই এই কারণেই ছিল এত দিন।
আক্ষেপ-কাব্যে আরেকটা পাতা যুক্ত হবে, ম্যাচ শুরুর পর অন্তত এটাই মনে হচ্ছিল। ২৪ মিনিটে আবারও গোল করে দলকে এগিয়ে দেন বলিভিয়ার অধিনায়ক মার্সেলো মার্তিনস মোরেনো। ‘আবারও’ বলা হলো এই কারণে, নিজেদের মাঠে আর্জেন্টিনাকে পেলেই যেন ‘পেলে’ হয়ে যান এই স্ট্রাইকার। গত ১৫ বছরে আর্জেন্টিনা বলিভিয়ার বিপক্ষে লা পাজে যে তিনটি ম্যাচ খেলেছে, প্রত্যেকটায় গোল করেছেন এই স্ট্রাইকার। এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডি-বক্সের বাম প্রান্ত থেকে উইঙ্গার আলেহান্দ্রো চুমাসেরোর ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে দলকে এগিয়ে দেন মোরেনো। তবে এর আগেও অন্তত দুটি সুযোগ পেয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার। প্রথমবার রাইটব্যাক সল তোরেস রোহাসের ক্রসে ঠিকঠাক মাথা ছোঁয়াতে পারেননি, ছোঁয়াতে পারলেই নিশ্চিত গোল হয়ে যেত। কারণ, নিজের জায়গা থেকে খামোকা বের হয়ে এসেছিলেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানি। এরপর গোলের ঠিক আগ দিয়ে আরেকটা ক্রসে একইভাবে গোল করতে ব্যর্থ হন মোরেনো।
আর্জেন্টিনা যে প্রথম থেকে খুব ভালো খেলছিল, তা নয়। বলিভিয়ারই ছিল আধিপত্য। তবে গোল খাওয়ার পর আস্তে আস্তে আক্রমণের ধার বাড়ান মেসিরা। ৩৯ মিনিটে মেসির এক শট প্রতিপক্ষের গায়ে লেগে দিক পালটে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরের মিনিটেই মিডফিল্ডার লিয়ান্দ্রো পারেদেসের এক শট গোলবারে লেগে ফিরে আসে। ৪২ মিনিটে লেফটব্যাক নিকোলাস তালিয়াফিকোর একটা মাপা পাসে গোল করতে ব্যর্থ হন মেসি।
তবে বিরতির ঠিক আগে দিয়ে ভাগ্য ফেরে আর্জেন্টিনার। বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন লওতারো মার্তিনেজ, সেখান থেকে বল কেড়ে নিতে সক্ষম হলেও ক্লিয়ার করতে গিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেন বলিভিয়ার ডিফেন্ডার হোসে মারিয়া কারাসকো। সামনে থাকা মার্তিনেজের গায়ে লেগে বল ঢুকে যায় জালে, সমতায় ফেরে আর্জেন্টিনা।
দ্বিতীয়ার্ধে আস্তে আস্তে ম্যাচের লাগাম নিজেদের হাতে তুলে নেয় আর্জেন্টিনা। ৫৩ মিনিটে তালিয়াফিকো দূর থেকে একটা শট নিলেও লক্ষ্যে পৌঁছোয়নি। ৬৭ মিনিটে মিডফিল্ডার ইজেকিয়েল পালাসিওসের পাস থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন মার্তিনেজ। ৭৫ মিনিটে মেসির পাস থেকে আরেকটা সহজ সুযোগ নষ্ট করে ইন্টার মিলানের এই স্ট্রাইকার। তবে কিছুক্ষণ পরেই একটা গোল বানিয়ে দিয়ে এসব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন এই স্ট্রাইকার। মেসির দুর্দান্তভাবে বানিয়ে দেওয়া এক বল মার্তিনেজ দখলে নিয়ে ডি-বক্সের বাঁ দিকে ফাঁকা দাঁড়িয়ে থাকা হোয়াকিন কোরেয়ার দিকে পাস দেন। জোরালো শটে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন লাৎসিওর এই স্ট্রাইকার। ২-১ গোলের জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টিনা।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রথম দুই ম্যাচ থেকে পুরো ছয় পয়েন্টের পাশাপাশি লা পাজ জয়ের স্বস্তিও সঙ্গী হলো মেসিদের।