গৃহবিবাদ পিছু ছাড়ছে না জাতীয় পার্টিতে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বিরোধ আরও তুঙ্গে। দলছুট নেতাদের একাংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য প্রার্থী তালিকাও তৈরি করছেন সাবেক এই ফার্স্টলেডি। অন্যদিকে পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরও বসে নেই। তিনিও একক নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ৩০০ আসনে প্রার্থীর তালিকা করছেন। রাজনৈতিক ইস্যুতে কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকও চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর মধ্যেই আসন্ন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে পৃথক প্রার্থী দিয়েছেন রওশন এবং জি এম কাদের। দুই প্রার্থীরই প্রতীক লাঙ্গল। একজন এরই মধ্যে ইসিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল হবে কার। উভয় পক্ষের নেতারা বলছেন, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হবে লাঙ্গল কার হাতে যাচ্ছে—রওশন এরশাদ, নাকি জি এম কাদেরের। যার পক্ষে প্রতীক বরাদ্দ হবে আগামী সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল তার—দলে এমন আলোচনা এখন ব্যাপক।
রওশনপন্থিরা বলছেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী হিসেবে রওশন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তা ছাড়া তিনি পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই বিবেচনায় তিনি দলের পক্ষে যে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারেন। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। তবে ইসি বিষয়টি বিবেচনা করবে। অন্যদিকে কাদেরপন্থিরা বলছেন, গঠনতান্ত্রিকভাবে পার্টির নির্বাচিত চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই হিসেবে তিনি ছাড়া অন্য কেউ দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দিতে পারেন না। ইসি রওশনের প্রার্থীকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দিলে তা হবে আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছাড়া তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া পার্টি ও দলীয় প্রতীক রেজিস্ট্রেশন এখন জি এম কাদেরের নামে। এই বিবেচনায় পার্টিপ্রধানের মনোনীত ব্যক্তিই প্রতীক পাওয়ার বৈধতা রাখেন।
উভয় পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলে সৃষ্টি হওয়া অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং জি এম কাদের ও রওশনের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে দূরত্ব বাড়ছে, যা আরও উসকে দিচ্ছেন মধ্যপন্থি ও পার্টি থেকে বহিষ্কৃত কিছু নেতা। বহিষ্কৃতদের সবাই আছেন রওশনের সঙ্গে। মধ্যপন্থিরা আছেন উভয় পক্ষেই। এর মধ্যে জাপার কয়েকজন সিনিয়র নেতাও রয়েছেন। যারা দূরত্ব নিরসনের নামে উভয় পক্ষে মনোরঞ্জনের চেষ্টার ব্যস্ত।
পার্টির সূত্রগুলো বলছে, বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিক
বৈঠক হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই গণভবনে ডেকে রওশন ও জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা বলেন। তার পরও বিরোধ মেটেনি।
এর কারণ হিসেবে রওশনপন্থিরা বলছেন, তাদের পক্ষ থেকে জি এম কাদেরের কাছে বহিষ্কৃত নেতাদের ফিরিয়ে নেওয়া, এরশাদপুত্র সাদকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া, রওশনকে যথাযথ মূল্যায়ন করা, তার পরামর্শ নিয়ে দল পরিচালনাসহ বেশকিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জি এম কাদের এসব শর্ত পূরণে অপারগতা প্রকাশ করায় ক্ষিপ্ত হন রওশনপন্থিরা। রওশনের স্থগিত করা দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য আবারও শুরু হয় তৎপরতা। জেলায় জেলায় দেওয়া হচ্ছে পৃথক কমিটি। সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করা হচ্ছে।
আপসে সম্মত নন জি এম কাদের। তিনি একাধিকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, সবার বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার সম্ভব নয়। যারা দলকে নিজের মনে করে না, পার্টির বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাদের আবারও ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তারা বহিষ্কৃতই থাকবে। তা ছাড়া আমি পার্টির বৈধ চেয়ারম্যান। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুন কালবেলাকে বলেন, দলের পক্ষ থেকে ঢাকা-১৭ আসনে লাঙ্গল প্রতীকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি। প্রতীক বরাদ্দের বিষয়টি ইলেকশন কমিশনের এখতিয়ার। তারা বিবেচনা করবে, কারা বৈধ।
আর জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন কালবেলাকে বলেন, সাংগঠনিক নিয়মে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রওশন এরশাদ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, অলংকারিক পদ। এ পদে থেকে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কারণ জাপার গঠনতন্ত্রে এরকম কিছু উল্লেখ নেই।
জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক সমরেশ মণ্ডল মানিক বলেন, মামলা নিষ্পত্তি শেষে নির্বাচন কমিশনে দল ও প্রতীকের রেজিস্ট্রেশন এখন জি এম কাদেরের নামে। পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন। নিয়মের মধ্যে থেকে ইসির পক্ষ থেকে রওশন এরশাদের প্রার্থীকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।