এতে তিস্তার ভারতের সংরক্ষিত এলাকায় হলুদ সর্তকতা জারি করা হলেও দোমহনী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় লাল সতর্কতা জারি করেছে সেচ দপ্তর। সিকিম দার্জিলিং ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর জেলা জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়িতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এদিকে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা কয়কদিনের গরমের পর টানা বৃষ্টি শুরু হয়। এতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বেড়ে যায়। পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। সঙ্গে কিছু কিছু প্লাবিত নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
নদীপাড়ের মানুষেরা বলছেন, গেল দুদিন ধরে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। নীলফামারীর ডিমলার ছাতনা এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে এই সব এলাকার পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল প্লাবিত হয়েছে। বড় বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে তিস্তাপাড়ের মানুষজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমা হচ্ছে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। শনিবার (২৬ আগস্ট) সকাল ৬টায় ৫২ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে।
অপরদিকে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেখানে বেলা তিনটায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে ২৯ দশমিক ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, রংপুরের কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার ৪০টি চরাঞ্চলের গ্রামে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাড়িঘর ৩ থেকে ৪ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ধান, পাটসহ শষ্য ক্ষেতগুলো তলিয়ে আছে পানিতে। পানিবন্দি মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে ও পাউবো বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি বেড়ে যাওয়াতে পানিবন্দি পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশুপাখি নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
রংপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত এলাকাগুলোর মধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, নোহালী ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম রয়েছে। কাউনিয়া উপজেলার ধুসমারার চর, আজম খাঁ চর, হাইবত খাঁ গোনাই, পল্লীমারী, চর একতা, চর মিলনবাজার, গোপীকাল্লা, ডালার চর ও চর গোদাই। এ ছাড়া পীরগাছার ছাওয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে।
পানি বৃদ্ধির ফলে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াসাম, চর খিতাবখা, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুড়া, রামহরি ও কালিরহাট এলাকায় দেখা দিয়েছে তিস্তা নদী ভাঙন। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে এবং ধরলার অববাহিকার মোগলবাসা ইউনিয়নের চরসিতাইঝাড় এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান মুন্সি রানা বলেন, তিস্তা নদী পানি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার বাম তীরে ভাঙন চলছে। দেখার যেন কেউ নাই। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে তো অনেকে বাড়ি ঘর জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
তিস্তা নদীর অববাহিকার গড়াই পিয়ার এলাকার বাসিন্দা শামিম রেজা বলেন, তিস্তা নদীর পানি গতকাল থেকে হুহু করে বাড়ছে। আমরা অনেক দুশ্চিন্তায় আছি। কেননা সবাই আমরা আমন আবাদ করেছি যদি সব নষ্ট হয়ে যায়। পানি বৃদ্ধির কারণে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমাদের।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হাদী জানান, নবম বারের মত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে রংপুরের গংগাচড়া কাউনিয়া, পীরগাছায়, পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পানিবন্দি মানুষদের উঁচু স্থানে ও তাদের শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে লালমনিরহাটের ভোটমারী, তুষভান্ডারের আমিনগঞ্জ, কাকিনা, পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অন্তত ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, তিস্তার পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। সে কারণে দুর্গম চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। অবিরাম বর্ষণ আর ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো জানান, ভারতের উজানে পানি বৃদ্ধির কারণে গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই খুলে দেওয়ায় শুক্রবার থেকে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর পানি মারাত্মক বেড়েছে। তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে ৪৪টি গেটের সবগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রবল স্রোতের কারণে নদী তীরবর্তী আশেপাশের গ্রামগুলোতে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন গ্রামে প্লাবন হওয়ায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুরে ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ মাসে আরো দু-একদিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।