আগামীকাল রোববার অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে থাকছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা। বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদেরও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঢাকার প্রবেশ পথসহ প্রায় প্রতিটি বড় রাস্তায় বসানো হয়েছে বাড়তি চেকপোস্ট। চেকপোস্টগুলোয় সন্দেহভাজন ব্যক্তি, বস্তু ও যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার নির্বাচনী কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে কয়েক হাজার বাড়তি সিসি ক্যামেরা। চলছে গোয়েন্দা নজরদারি। নির্বাচন নিয়ে গুজব ঠেকাতে কঠোর মনিটরিং চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
শুক্রবার ঢাকার মিরপুর, শ্যামলী, আদাবর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, আজিমপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে রাজধানীজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা বলয়। প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় পুলিশকে অস্ত্র হাতে টহল দিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে নির্বাচনী কেন্দ্রগুলো ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। কেন্দ্রের প্রবেশ পথেই বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। এছাড়া প্রতিটি বড় বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে তল্লাশি চৌকি। এসব চৌকিতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাগ, বিভিন্ন ধরনের বস্তু ও গাড়িতে তল্লাশি করতে দেখা গেছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সারা দেশে টহল জোরদার করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবের বিশেষ টহল চলছে ঢাকায়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবকে বিভিন্ন এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে টহল দিতে দেখা গেছে। এতে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে থাকা বাড়তি আতঙ্ক কেটে গেছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি রাস্তায় থাকায় মানুষের মধ্যে বাড়তি স্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে।
অনেকেই বলেছেন, সেনাবাহিনী ও বিজিবি মাঠে থাকায় সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছেন। তারা নির্ভয়ে এলাকায় যার যার কাজকর্ম আরও সুন্দরভাবে করতে পারছেন। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যারা নানাভাবে হুমকিধামকি দিয়েছেন এবং দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতির কারণে তারা গা ঢাকা দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার আশুলিয়ায় অবস্থিত ল্যান্ডিং স্টেশন, আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী পর্বতা সিনেমা হল, গাবতলী ব্রিজ, আমিনবাজার ঢাল, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, পুরান ঢাকার মুকিমবাজার ও শ্যামপুরসহ ঢাকার প্রতিটি প্রবেশ পথে বসেছে পুলিশ ও র্যাবের বাড়তি চেকপোস্ট। চেকপোস্টে তল্লাশি চলছে। তবে তল্লাশির নামে কাউকে হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে ঢাকার বাইরে থেকে কেউ যাতে রাজধানীতে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য এমন কড়াকড়ি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। চেকপোস্ট স্থাপনের মূল উদ্দেশ্যই এটি। এছাড়া নাশকতা চালানোর পর কেউ যাতে ঢাকার বাইরে গিয়ে আত্মগোপন করতে না পারে সেদিক বিবেচনা করেই ঢাকার প্রবেশ ও বের হওয়ার প্রতিটি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত বুড়িগঙ্গা সেতু দুটিতে বসানো হয়েছে বিশেষ চেকপোস্ট। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভারগুলোর ওঠার মুখেও বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি। এছাড়া মেট্রোরেলের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ট্রেন ছাড়াও অন্যান্য পাবলিক পরিবহণ রাখার স্টেশন বা টার্মিনালেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে চলছে বাড়তি গোয়েন্দা নজরদারি। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়। বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো।
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে মাঠে থাকা সব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা প্রস্তুত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান নির্বাচন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েনকৃত বিজিবি সদস্যদের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। শুক্রবার ঢাকায় মোতায়েন করা বিজিবির কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পরে তিনি মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্স এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বিজিবি প্রধান বলেন, নির্বাচনে যে কোনো ধরনের নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবির প্রত্যেক সদস্য প্রস্তুত রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে দেওয়া দায়িত্ব পালনে বিজিবি পিছপা হবে না। বিজিবি বরাবরই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল রাখতে সারা দেশে বিজিবি সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। বিশেষ প্রয়োজনের জন্য দুটি কুইক রিয়াকশন টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সারা দেশে ১০০টি ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী কেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে গুজব প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বিজিবি।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক জানান, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আনসার-ভিডিপির ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ জন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক সারা দেশের ৪২ হাজার ১৪৯টি ভোট কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ২৫০ প্লাটুন আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যরা এক হাজার ভাগে বিভক্ত হয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ করছে। তারা আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে থাকবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর তরফ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
র্যাব মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এম খুরশীদ হোসেন জানান, সারা দেশে র্যাব গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন। নজরদারি করা। জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারসহ সাইবার ওয়ার্ল্ডে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্বাচনে যে কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে র্যাব। প্রস্তুত রাখা হয়েছে র্যাবের ডগ স্কোয়াড, বম্ব ডিসপোজাল টিম, হেলিকপ্টার, স্পেশাল ফোর্সসহ অন্যান্য টিম ও সরঞ্জামাদি।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড বাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোস্ট গার্ড অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বাহিনীটি নির্বাচন পূর্ববর্তী, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছে বাহিনীটি। উপক‚লীয় এলাকার ৪৩টি ইউনিয়নের সার্বিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের মাঠে থাকার কথা রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান জানান, রাজধানীর ২ হাজার ১৪৬টি ভোট কেন্দ্রের অর্ধেকই গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকার মেস, হোটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অব্যাহত আছে।
ডিএমপি কমিশনার আরও জানান, ঢাকার অদূরে থাকা কিছু কেন্দ্রে ট্রলার দিয়ে যেতে হয়। এসব কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে সেনাবাহিনী ও বিজিবি। নির্বাচনে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তৎপর থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একাধিক গোষ্ঠী নির্বাচনবিরোধী কার্যক্রম ও অপতৎপরতা চালাচ্ছে। গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ফায়ার সার্ভিসের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। দেশের সব ফায়ার স্টেশনে কর্মরতদের স্ট্যান্ডবাই থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনকালীন জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ফায়ার স্টেশনগুলোর দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ছাড়াও প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়ারদের। অগ্নিনির্বাপণের যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধার সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সর্বদা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে পৃথক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩। ঢাকায় স্থাপিত কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল থেকে পুরো দেশের ফায়ার স্টেশনের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের জন্যও হটলাইন নম্বর ০১৭৩০৩৩৬৬৯৯ চালু করা হয়েছে। এই নম্বরে ফোন করেও যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারবে।