সোহেল রানা সোহাগ,সিরাজগঞ্জ থেকে ঃ
মানুষ ও পাখির মধ্যে বিরল বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছেন চলনবিলের সলঙ্গা থানার
বোয়ালিয়ারচর গ্রামের পাখি প্রেমিক হায়দার আলী মাস্টার। নিরন্তর প্রেম ও পরিচর্যায়
তার পোষ মানানো পাখিদের নাম ধরে ডাকলেই কাছে আসে। ঈশারা বুঝে কাঁধে বসে,
হাতে বসে। পকেট থেকে খাবার তুলে খায় বাধ্য মানব শিশুর মতো। ভালবাসা, শাসন, আদর,
সবই যেন বোঝে মানুষের মত। যা সচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
সরেজমিনে চলনবিল অঞ্চলের সলঙ্গা থানার নলকা ইউনিয়নের বোয়ালিয়ার চর গ্রামে গিয়ে
দেখা গেল এই বিরল দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা। জানা গেল, বোয়ালিয়ারচর গ্রামে আফজাল আকন্দ’র
ছেলে হায়দার আলী গ্রামের দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। শৈশবকাল থেকেই
পড়াশোনার পাশাপাশি পশু-পাখি লালন-পালন ও তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান ছিল তার
প্রিয় শখ। উজাড় হয়ে যাওয়া বন থেকে বিপন্ন বেজির বাচ্চা উদ্ধার করে পরিচর্যা করে
পোষ মানানো, হৃদয়হীন কতিপয় লোকের ফেলে দেয়া বিড়াল-কুকুরের ছানা রাস্তা থেকে
তুলে এনে লালন পালন করে পরিপুষ্ট করে তাদের নাম রাখা। রোগ-ব্যধি হলে তাদের
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়াসহ মমতাময় পরিচর্যায় এক বিচিত্র জগত তিনি
গড়ে তুলেছেন। অপরের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার এসব ভাষাহীন প্রাণির প্রতি ছিল তার
শৈশবকাল থেকেই অপার মমতা ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ। তার বাড়িতে অনেক কবুতরের
সমারোহ। তিনি পশু-পাখিকে এমন ভাবে আদর যতœ করেন যে কোন পশু-পাখি তার
পরিচর্যা ও ভালবাসার ছোঁয়া পেলে আর বনে ফিরতে চায় না। একারণে এলাকার লোকেরা
তাকে ‘পাখি-বাবা’ বা ‘পাখি প্রেমিক’ হায়দার মাস্টার বলে ডাকে। মৌমাছি পালন
করে মধু সংগ্রহ করাও ছিল তার শখের একটি অংশ।
প্রায় ৯ মাস পূর্বে রায়গঞ্জ -সিরাজগঞ্জ (পুরাতন বগুড়া রোড) সড়কে মীরের দেউল মুড়া
বাজারে শত বছরের পুরাতন কড়ই গাছ থেকে লাকড়ি (খড়ি) সংগ্রহ করতে গিয়ে গাছের
কুঠুরি থেকে স্থানীয় কাঠুরিয়ারা ৪টি টিয়া পাখির ছানা পায়। খবর পেয়ে পাখি
প্রেমিক হায়দার আলী দুই হাজার টাকায় কিনে টিয়া পাখির ছানাগুলি বিপন্ন অবস্থায়
বাড়ি নিয়ে আসেন। ছোলা, আম, গম, ভুট্রা, কাউন, সূর্যমুখী-কুসুম্বা ফুলের
বিচি, শালনী ধানসহ পাখির গুড়াখাদ্য খাইয়ে পাখিগুলোকে পয়মন্ত করে তোলেন।
প্রতিদিন ৬০/৭০ টাকা ওদের জন্য খরচ হয়। প্রাথমিক ভাবে বেজি, বিড়াল, শিয়াল ও
কুকুরের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য পাখিগুলি কিছুদিন খাচায় রেখেছিলেন। এখন আর
খাঁচায় রাখতে হয় না। সকালের নাস্তা সেরে টিয়াপাখিগুলি উড়ে বেড়িয়ে দুপুরে বাসায়
ফিরে পানি, খাদ্য খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর বিকালে বাইরে বেড়িয়ে সন্ধ্যায়
আবার ঘরে ফেরে এসব টিয়া পাখি। বাড়ি ঘরের বিভিন্ন স্থানে ওরা স্বাধীনভাবে থাকে।
বড় টিয়া পাখিকে ‘পীর বাবাজি’ তার ছোটটিকে ‘শাহজাদা’ তৃতীয়টিকে
‘রাণীজি’ আর সবচয়ে ছোট টিয়াকে ‘টুনি’ বলে জোরে ডাকলেই তারা উড়ে
এসে মাষ্টারের কাঁধে, মাথায় ও হাতের উপর এসে বসে। হাতে ও পকেটে থাকা খাবার খায়।
আবার চলে যেতে বললেই উড়ে চলে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে হায়দার আলী মাস্টার বলেন- বন্যপ্রাণি নিধন করা, আটক রাখা
বেইআইনী ও শাস্তি মূলক অপরাধ। তাই আমি ওদের আটকে রাখিনা। খাবার সময় হলে ওরা
আসে। খাবার খেয়ে আদর নিয়ে চলে যায়। ওরা ডানা মেলে মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে ঘুরে
বেড়িয়ে আবার রাত্রি যাপনের জন্য বাড়িতে ফিরে আসে। ওরা আমার ভালবাসার খাঁচায়
বন্দি। তাই লোহার খাঁচা প্রয়োজন হয় না। কেউ যেন পাখি শিকার না করে এব্যাপারে
তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রচার প্রচারণা করে থাকেন। বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি
সংরক্ষণ আইন মেনে সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলে পাখি নিধন বন্ধ করার
পাশাপাশি ওদের নিরাপদ আবাসন তৈরি করে দিয়ে ভালবাসা, যতœ আর খাদ্য প্রদানের
মাধ্যমেই পাখিদের অভয়ারণ্য তৈরি করা সম্ভব বলে পাখি প্রেমিক হায়দার আলী মাষ্টার
জানালেন। #