আব্দুল আউয়াল, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি ॥ শহর থেকে প্রায় ৮
কি.মি. দূরে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও বেতার কেন্দ্রটি এক শ্রেণির
দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্বেষী মহলের দৌরাত্মে কেন্দ্রটি এখন
প্রায় নামসর্বস্ব কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও
বিভিন্ন সমস্যার জন্য কেন্দ্রটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে
দাঁড়িয়েছে।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিভিশনের ঠাকুরগাঁও
সম্প্রচার কেন্দ্রটি উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। এ উপলক্ষে ওইসময়
তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তিনদিন আগে থেকে
ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থান করছিলেন। এসময় স্থানীয়
সাংস্কৃতিকর্মীরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করে ঠাকুরগাঁও বেতারের
সম্প্রচার কেন্দ্রটিকে পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র হিসেবে চালু করার
দাবি জানান। তিনি বেতার কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে বিষয়টি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাবেন বলে আশ্বাস দেন।
টেলিভিশনের ঠাকুরগাঁও সম্প্রচার কেন্দ্রটি উদ্বোধনের পরে এক
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠাকুরগাঁও বেতার
কেন্দ্রটিকে পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র হিসেবে চালু করার ঘোষণা
দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন সরকারের তথ্যমন্ত্রী
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রাথমিক ভাবে ২ ঘন্টার স্থানীয় অনুষ্ঠান
প্রচার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে
বর্তমানে ২ ঘন্টার এফএম অনুষ্ঠানসহ ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান প্রচার
করা হচ্ছে।
কেন্দ্রের নানান সমস্যা থাকার পরও প্রথমদিকে স্থানীয়
সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহযোগিতায় স্থানীয় অনুষ্ঠান ধারণ ও
প্রচার কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মেই চলছিলো। কিন্তু ২/৩ বছর পর
থেকে দিনের পর দিন ব্যক্তি বিশেষের স্বেচ্ছাচরিতা, দুর্নীতি ও
অনিয়মের কবলে পড়ে বেতার কেন্দ্রটি দুর্নীতিবাজদের আখড়ায়
পরিণত হয়।
এই বেতার কেন্দ্রে সহকারী পরিচালকের দু’টি পদেই লোক নেই।
কাগজে কলমে একজন আছেন। কিন্তু তিনি ৬ মাসের ফাউন্ডেশন
ট্রেনিং এ ঢাকায় আছেন। বেতারের প্রকৌশল শাখার আঞ্চলিক
প্রকৌশলী পদটি ফাঁকা পড়ে আছে। ৩জন উপআঞ্চলিক প্রকৌশলীর
মধ্যে আছেন মাত্র একজন। সহকারী বেতার প্রকৌশলীর ৪টি পদের
মধ্যে ২টি ফাঁকা। ২টি পদে লোক থাকলেও একজন দীর্ঘদিন থেকে
ট্রেনিং এ আছেন। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বার্তা বিভাগের।
বার্তা শাখাটি চলছে কর্মকর্তা ছাড়া। আঞ্চলিক পরিচালক
জানান, বার্তা বিভাগে উপ-বার্তা নিয়ন্ত্রক ও সহকারী বার্তা
নিয়ন্ত্রক পদ থাকলেও লোক নেই। বার্তা বিভাগ কিভাবে চলছে তা
তিনি জানেন না। তবে তাঁর কাছে সংবাদ নিয়ে আসলে তিনি
চোখ বুলিয়ে দেখেন।
ইতিপূর্বে এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির
কারণে এ বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য সময়মত
প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ফলে আগের তুলনায়
মানসম্পন্ন অনেক অনুষ্ঠান প্রচার কমে গেছে। ৪/৫ বছরেও অনেক
শিল্পী বেতারে অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ পাননা। এখানে উল্লেখযোগ্য
দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে বছরের পর বছর অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের
সুযোগ এবং পূণঃ প্রচারিত কোন অনুষ্ঠানের শিল্পী সম্মানী না
দিয়ে ভুয়া বিল করে টাকা আত্মসাৎ করা। অভিযোগ রয়েছে
তোষামোদী পছন্দের শিল্পী/ব্যক্তিদের একই দিনে চার পাঁচটি
অনুষ্ঠান করার সুযোগ দিয়ে টাকা তুলে ভাগাভাগি করা হয়।
অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীদের মেধা বিবেচনা করা হয়না ও
অনুষ্ঠানের মান যাচাই না করে প্রচারিত হয়। সম্প্রতি প্রায়
কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি স্টুডিও নির্মিত হলেও
উদ্বোধনের আগেই সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
আঞ্চলিক পরিচালক জানান, এর সাউন্ডপ্রুফ নষ্ট হয়ে গেছে, ইকো
প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে কক্ষটিকে কর্মকর্তাগন
খেলার ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন।
বেতারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত আবাসিক
বাসস্থান থাকলেও বাসাগুলি ব্যবহার না করায় সেগুলি এখন ব্যবহারের
অনুপযুক্ত। জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে ভবনগুলি। ৪টি ভবনের প্রায় ২০টি
কোয়ার্টার পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
তাছাড়া কর্মকর্তাগন শিল্পী/অভিভাবকদের বেতারের বিশ্রাম
কক্ষটিকে আবাসন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছেন। বেতার কেন্দ্রে
প্রবেশদ্বারের পাশে এই কক্ষটিতে অনেকেই পরিবার নিয়েও বসবাস
করে গেছেন। বর্তমানে সেখানে বেতার কেন্দ্রের উপ আঞ্চলিক
পরিচালক বাস করছেন। ফলে শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে এসে ফ্লোরে
বসে অপেক্ষা অথবা এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করেন। এব্যাপারে
বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মো. সেলিম জানান, আগে থেকেই
এখানে কর্মকর্তাগণ বসবাস করছেন। বেতারের মতো একটি
প্রতিষ্ঠানের মহড়া কক্ষ না থাকায় শিল্পীদের বারান্দায় বা করিডোরে
রিহার্সেল করতে হয়।
বেতারের বিস্তীর্ণ এলাকার গাছের ফলমুল নিলাম করা হয়না ও
ডালপালা কেটে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেতারের
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না কিনে অধিক ভাড়া দেখিয়ে সেই
টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে।
অনেক শিল্পীর সম্মানী ১১০ টাকা। অথচ দু’দিন মহড়া আর একদিন
রেকর্ডিংয়ে যাওয়া আসার জন্য তাঁর খরচ হয়ে যায় প্রায় ২শ’
টাকা। আর ৫ মিনিটের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য যাতায়াত
করতে হয় তিন দিন। এজন্য এই কেন্দ্রে আসতে অনেক শিল্পী
আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
শিল্পীসম্মানী আর অনুষ্ঠানের জন্য শিল্পীদের মনোনয়ন নিয়ে রয়েছে
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। একজনকে একই দিনে একাধিক
অনুষ্ঠান অংশগ্রহণের বিধান না থাকলেও তোষামোদির কারণে
ব্যক্তি বিশেষকে এক দিনে চার পাঁচটি অনুষ্ঠানও করতে দেখা যায়।
দু’জন ব্যক্তিকে বেশি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের হার অতীতের সকল
রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তাছাড়া দু’জন চুক্তিবদ্ধ শিল্পীর নামে দীর্ঘ
১০ বছর ধরে প্রতি মাসে বিল উত্তোলন হলেও বেতার কেন্দ্রে বাস্তবে
ওই নামের কাউকে দেখা যায়নি। একজন অস্তিত্বহীন এক শিল্পীর
সন্ধানও পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। এ শিল্পীর স্বামী বেতার কেন্দ্রের
একজন ঘোষক। তিনি নাকি স্ত্রী’র নামে বিল তুলে নেন।
কর্তৃপক্ষের মনোনীত এমন অনেক চুক্তিভিত্তিক শিল্পী-কলাকুশলী
রয়েছেন, তারা নিয়মিত কেন্দ্রে না এসে সম্মানী তোলার জন্য
২/১দিন হাজির থাকেন। অনুষ্ঠান ঘোষণার জন্য ৩৩ জন
চুক্তিভিত্তিক শিল্পী থাকলেও প্রয়োজনের সময় তাদের পাওয়া যায়না।
তখন তবলা বাদক বা ডিও’র দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে দিয়ে অনুষ্ঠান
ঘোষণা দেওয়া হয়। চুক্তিভিত্তিক শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাবদ বেতার
কেন্দ্র থেকে টাকা উত্তোলনের সর্বোচ্চ পরিমান নির্দিষ্ট করা
থাকলেও কেউ কেউ বেশি অনুষ্ঠান করে দ্বিগুন টাকা উত্তোলন করেন।
ফলে অন্য শিল্পীরা অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হন। এই বেতার কেন্দ্রের ৭
জন নিজস্ব শিল্পী রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বেতার কেন্দ্রে
নিয়মিত আসেন না। কোন কোন শিল্পী বেতন নেওয়ার জন্য মাসে
দু’একদিন আসেন। আঞ্চলিক পরিচালক জানান, আগে হয়তো
এরকম হয়েছে, তাঁর আমলে এরকম হচ্ছেনা।
বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা কক্ষের শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি প্রায় ১০
বছর ধরে বিকল থাকলেও সেদিকে কারো নজর নেই। পুরো বেতার
কেন্দ্রে অনুষ্ঠান ধারণের জন্য মাইক্রোফোন আছে মাত্র ৪টি।
একাধিক যন্ত্রী ও শিল্পী সমন্বয়ে যখন কোন গান রেকর্ড করা হয়
তখন একজনকে সরিয়ে দিয়ে আর একজন জায়গা দখল করেন।
নাটকের ক্ষেত্রেও তাই হয়। এতে ভালো মানের অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়
না।
প্রায় একযুগ ধরে বেতার কেন্দ্রের কীবোর্ডটি ভাড়ায় এনে
ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটির মালিকও বেতারে একজন কর্মচারী।
একযুগে যতটাকা কীবোর্ডের ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে তা
দিয়ে বিশ্বমানের কয়েকটি কীবোর্ড কেনা যেত। এছাড়া দেশের
অধিকাংশ বেতার কেন্দ্রের রেকর্ডিং হাউস (ব্রডকাস্টিং হাউস)
শহরে অবস্থিত। কিন্তু একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের
স্বার্থের জন্য ঠাকুরগাঁও বেতার কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং হাউস শহরে
করা হচ্ছে না।
সমস্যা ও দুর্নীতির বিষয়ে ঠাকুরগাঁও কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক
মো. সেলিম জানান, এ কেন্দ্রের পূর্ববর্তী কর্মকর্তাদের
অভিযোগের কারণে এ কেন্দ্রে ভালো কোন কর্মকর্তা আসতে বা
থাকতে চান না। আমি চেষ্টা করছি বদনামের কোন অভিযোগ না
নিয়ে সুনাম রক্ষা করে নিয়ম মোতাবেক কাজ করার জন্য। তবে এখন
যে অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে তার সবগুলোই সঠিক নয়।
কতিপয় ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ হয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হতে
পারে।