পুলিশের হাতকড়া লাগানো থাকে আসামির হাতে। কোনো কোনো সময় কোমরে বাঁধা থাকে রশি। থাকে পুলিশের তীক্ষষ্ট পাহারা। এরপরও পুলিশের সামনেই ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে আদালত এলাকা থেকে পালিয়ে যায় আসামি। গত তিন বছরে এভাবে দেশের সাতটি আদালত থেকে অন্তত ১৫ দুর্ধর্ষ আসামি লাপাত্তা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকার আদালত থেকেই পালিয়েছে ৯ আসামি। অন্য ছয় আসামি রাজশাহী, বরিশাল, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরীয়তপুরের আদালত এলাকা থেকে পালায়। পালিয়ে যাওয়ার পর এসব আসামির অনেকেই এখন পর্যন্ত অধরা। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকার আদালত থেকে ধর্ষণ মামলার আসামি ও বাড্ডার চিহ্নিত সন্ত্রাসী রাফসান ওরফে রুবেল পালিয়ে যায়। একই দিন রাজশাহীর একটি আদালত থেকে পালিয়েছে মাদক মামলার এক আসামি। গ্রেফতারের পর থানা থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে নেওয়ার পর আদালত এলাকা থেকে নানা কৌশলে এসব আসামি পালিয়ে যায়।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশের গাফিলতি আর অবহেলার কারণে আদালতপাড়া থেকে মামলার আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যথাযথ নিয়ম মেনে তাদের আদালতের হাজতখানায় না রাখায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তা ছাড়া পালিয়ে যাওয়া আসামিদের ক্ষেত্রে রহস্যজনকভাবে ঢিলেঢালা পাহারার দৃশ্যও দেখা .গেছে। অভিযোগ উঠেছে, পাহারায় থাকা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে সুযোগ নিয়েই পালাচ্ছে আসামি।
রোববার দুর্ধর্ষ আসামি রুবেল পালানোর পর গতকাল সোমবার ঢাকার আদালত এলাকায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে কোর্ট হাজত থেকে এজলাসে আসামি হাজির করার ঢিলেঢালা ব্যবস্থার দৃশ্যও চোখে পড়েছে। অনেক আসামিকে হাতকড়া না পরিয়েই হাজতখানা থেকে বের করতেও দেখা যায়। একাধিক আসামিকে মাত্র একজন কনস্টেবল হাজত থেকে এজলাসে নেওয়ার সময় ওই আসামির স্বজনদের সঙ্গে গভীর সখ্যের দৃশ্যও চোখে পড়েছে। হাজত থেকে এজলাসে তোলার ফাঁকে আসামিকে টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও করে দিচ্ছে পুলিশ। এভাবে সখ্য গড়ে তুলেই পালিয়ে যাচ্ছে আসামি।
কোতোয়ালি থানার ওসি আবুল হাসান সমকালকে বলেন, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার আদালত থেকে তিন আসামি পালিয়ে যায়। তবে ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় দুজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও রোববার পালিয়ে যাওয়া আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
ওসি বলেন, আদালতে কোনো আসামিকে হাজির করা হলে ওই আসামির দায়িত্ব থাকে কোর্ট পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তার। সাধারণত থানা পুলিশ ওই আসামিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন না। কোনো আসামি লাপাত্তা হলে নিয়ম অনুযায়ী তার থানায় শুধু মামলা হয়।
রুবেলের পালানো নিয়ে নানা রহস্য: রুবেল বাড্ডা এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো স্পর্শকাতর মামলাসহ মোট ৯টি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ বাড্ডায় গত ২৫ অক্টোবর বিকেলে হবু স্বামীর সামনে থেকে তুলে নিয়ে এক গারো তরুণীকে ধর্ষণ করে রুবেল। এর ১৭ দিন পর গত শুক্রবার র্যাব গ্রেফতার করে শনিবার তাকে বাড্ডা থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এমন আসামিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই এমরানুল ইসলাম মাত্র একজন কনস্টেবল নিয়ে আদালতে নিয়ে আসেন। ওই আসামিকে নিয়ম অনুযায়ী কোর্ট হাজতে না নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। খাস কামরার সামনে কনস্টেবল দীপক চন্দ্র পোদ্দারের কাছে রুবেলকে রেখে ভেতরে অবস্থান করেন এসআই এমরানুল। এ সুযোগে পালিয়ে যায় রুবেল। চিহ্নিত একজন সন্ত্রাসীকে কেন ঢিলেঢালা নিরাপত্তায় আদালতে তোলা হলো সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা সিএমএম কোর্টের হাজতখানার ইনচার্জ উপপরিদর্শক রুহুল আমিন বাংলার প্রতিদিনকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী থানা থেকে আসামিকে কোর্টে নেওয়া হলে কোর্ট হাজতে লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তা না করে তাকে সরাসরি আদালতে নিয়ে যান। এজন্য ওই আসামির বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য ছিল না। পালিয়ে যাওয়ার পরই তিনি ঘটনা জানতে পারেন।
আদালত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, রুবেল ধর্ষণ মামলার আসামি হলেও তদন্ত কর্মকর্তা তার কোনো রিমান্ড আবেদন করেননি। তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের জন্য সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় নিয়ে যান তদন্ত কর্মকর্তা। তবে ওই আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করে। এরপর তাকে নিয়ে খাস কামরার সামনে কেন কনস্টেবল ও এসআই দাঁড়িয়ে ছিলেন তা রহস্যজনক।
তবে বাড্ডা থানার এসআই এমরানুল হাসানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে। আদালত এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে রুবেল পালিয়ে যায়। হাতকড়া পরা ডান হাতটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ওই আসামিকে বীরদর্পে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়ে ওই ফুটেজে। ওই সময় সেখানে একাধিক পুলিশ সদস্যকেও দেখা যায়।
অন্য ১২ আসামির পলায়ন: আদালত ও বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার রাজশাহী জেলা জজ আদালত চত্বর থেকে মোখলেসুর রহমান নামে মাদক মামলার এক আসামি পালিয়েছে। গত ৬ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত থেকে ডাকাতি মামলার আসামি মনির হোসেন পালিয়ে যায়। এর আগে গত ১১ আগস্ট কেরানীগঞ্জের শিশু পরাগ অপহরণ মামলার অন্যতম আসামি মুক্তার হোসেন আমির এবং গত বছরের নভেম্বরে কাফরুলের ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন হত্যা মামলার আসামি পুলিশের এসআই রেজাউল করিম পাটোয়ারী ঢাকার আদালত এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। গত ১৮ আগস্ট শরীয়তপুরের আদালত থেকে মাদক মামলার আসামি আবদুস সামাদ হাতকড়া নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ২ জুলাই বাগেরহাট আদালত থেকে ডাকাতি মামলার আসামি দেলোয়ার হাতকাড়া পরা অবস্থায় পালিয়ে যায়। এ ছাড়া গত জুনে বরিশালের আদালত থেকে মাদক মামলার আসামি শামিম ও গত বছরের মে মাসে শেরপুরের আদালত থেকে হত্যা মামলার আসামি হাফিজুর রহমান পালিয়ে যায়।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আদালত থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যা মামলার ৪ আসামি আশিকুর রহমান, খান মোহাম্মদ ওরফে রইস, মাহবুব আকরাম ও ইশতিয়াক পালিয়েছিল। একই বছরের আগস্টে ঢাকার আদালত থেকে একটি দুর্নীতি মামলার আসামি দুই চিকিৎসক মশিউর রহমান এবং আতিয়ার রহমান পালিয়েছিলেন।