ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি হেলাল শেখঃ
‘ক্রাইম জোন’-এলাকা হিসাবে পরিণত হয়েছে রাজধানীর নিকটবর্তী শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি-
সন্ত্রাস আর মাদক ব্যবসা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা আশুলিয়াবাসীর কাছে। গত বছরের পুলিশ উদ্ধার
করেছে প্রায় ১২৩টি লাশ। পুলিশি তৎপরতার অভাব এবং অতিমাত্রায় দুর্নীতির কারণে আশুলিয়ার যত্রতত্র মিলছে
অজ্ঞাতনামা লাশ। শুধু তাই নয়, খোদ থানা কম্পাউন্ডের পুলিশ মেসে খুনের ঘটনা ঘটেছে, তবে আশ্চর্যের বিষয়
হলো বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কূলকিনারা হয়নি। অপরাধ দমন বাদ দিয়ে পুলিশ সদস্যরাই জড়িয়ে পড়ছে
বিভিন্ন অপরাধে।
অভিযোগ উঠেছে, লাশকে পুঁজি করে প্রায়ই নানারকম হয়রানির আয়োজন করে পুলিশ। ভাড়াটে গার্মেন্ট কর্মী
আত্মহত্যার ঘটনায় বাড়ির মালিকদের ধরে এনে থানার লকআপে আটকে রাখার অসংখ্য নজির রয়েছে। চাহিদা
মাফিক টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের খুনি সন্দেহে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়, তবে টাকা পেলেই পাল্টে যায়
চিত্র। বানানো হয় মামলার সাক্ষী।
জানা গেছে, শুধু খুন খারাবিই নয়, অন্যান্য অপরাধেরও নিরাপদ আখড়া হয়ে উঠেছে আশুলিয়া। ধান্ধাবাজি,
চাঁদাবাজি ও মাসোয়ারা ধকলের জের ধরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডাকাতি, রাহাজানি, জবরদখলের মচ্ছব। সবচেয়ে
বেড়েছে ধর্ষণের তাণ্ডব। লাশের সংখ্যাকেও টেক্কা দিয়েছে ধর্ষণসহ নারীঘটিত অপরাধসমূহ। গার্মেন্ট কর্মী অধ্যুষিত
আশুলিয়ার বেশির ভাগ এলাকায়ই নারী শ্রমিকরা ধর্ষক ও চাঁদাবাজ আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। তবে জীবিকার
তাগিদে তারা ওইসব এলাকায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে অনেক ভুক্তভোগীর কথা হলেও তারা নাম
প্রকাশে রাজি হননি। এলাকাবাসী বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী বখাটেদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না
নারী নির্যাতনের ঘটনা। ভুক্তভোগীরা ভয়ে থানার দ্বারস্থ হন না। ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে
অভিযোগকারীকে নিরুৎসাহিত করে স্থানীয় পর্যায়ে মিট-মীমাংসা করার পরামর্শ দেওয়া হয় পুুলিশের পক্ষ থেকে।
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত), এসআইসহ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা
রয়েছে। আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগ নেত্রী ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনে পুলিশের ওসিসহ কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে
আদালতে মামলা করেন। ঢাকার ১নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে করা এ মামলায় থানার ওসি (তদন্ত)
এসআইসহ অজ্ঞাত আরও ৪/৫ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। অতি সম্প্রতি একজন স্কুল শিক্ষিকাকে তার
বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে গণধর্ষণ করার ব্যাপারেও মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে টানবাহানা করে পুলিশ। স্থানীয়রা নাজমুল
নামে এক ধর্ষককে আটক করে দিলেও বাকি আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে পুলিশের নীরবতা নিয়ে নতুন করে
আবার প্রশ্ন উঠেছে। এর বাইরে গত চার মাসে চার্জশিট দেওয়ার আগে ধর্ষণ সংক্রান্ত অন্তত ১৫টি মামলা পুলিশের
মধ্যস্থতায় মীমাংসার ঘটনা ঘটেছে।
মাসোয়ারা সব খাতেই : বাদাম বিক্রেতা হকার থেকে শুরু করে ফুটপাথ দোকানি, ভাঙ্গারি পট্টি, ঝুট ব্যবসায়ী,
অবৈধ অটো বাণিজ্য, মত্স্য আড়ত, হোটেল-রেস্তোরাঁ, রেন্ট-এ-কার, নকল কারখানা, ইটভাটা, লাইসেন্সবিহীন
ফার্মেসি, মাদক ব্যবসায়ী, গ্যাস ঠিকাদার নিয়ে অর্ধশতাধিক খাত থেকে দৈনিক ও মাসিক হারে ধার্যকৃত মাসোয়ারা
উঠাচ্ছে পুলিশ। আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে ধরা হয় গ্যাস খাতকে। থানার যে কোনো এলাকায় প্রতিটি চোরাই
গ্যাস সংযোগ বাবদ ৬০ হাজার টাকা পুলিশের নামে বরাদ্দ রাখতে হয়। এ টাকা আদায়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিট
অফিসারের। পুলিশ ও ঠিকাদারের সমন্বয়ে আশুলিয়া থানা এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাসের ৩০ হাজার চোরাই
সংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অতি সম্প্রতি কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানি
প্রায় ১০ হাজার চোরাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে পুলিশের টাকা
নেওয়ার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশুলিয়া থানা এলাকার অ
র্ধশতাধিক ভাঙ্গারি দোকান থেকে প্রতি মাসে আড়াই লক্ষাধিক টাকা, পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত ৭টি
ইটভাটা থেকে প্রায় ২ লাখ, বাইপাইল মত্স্য আড়ত থেকে মাসে এক লাখ বিশ হাজার টাকা, বলিভদ্র বাজারে খাস
জমির ওপর গড়ে তোলা অবৈধ দোকানিদের থেকে লক্ষাধিক টাকা, ডিইপিজেড এলাকার ফুটপাথ-হকার্সদের কাছ
থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা হিসেবে মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা, জিরানীবাজার ও স্ট্যান্ডকেন্দ্রিক হকারদের
থেকে প্রায় দিনে ১০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে তিন লাখ টাকা, আশুলিয়া বাঁশপট্টি থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার
টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ ফুটপাথ বাজার থেকে মাসে দেড় লক্ষাধিক টাকা, বাইপাইল প্রাইভেট কার স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন
আট হাজার টাকা হিসেবে মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা, বাসস্ট্যান্ড থেকে সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা, পিকআপ স্ট্যান্ড
থেকে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা, জিরানী প্রাইভেট কার স্ট্যান্ড থেকে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ প্রাইভেট
কার স্ট্যান্ড থেকে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা, ঝুট ব্যবসায়ীদের শতাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা
আদায় করা হয়। মাসোয়ারা এবং বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল
কাদিরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সব কিছুই বানোয়াট এবং অপপ্রচার। পুলিশ
তিতাসের কেউ না। তিতাস কর্তৃপক্ষ ম্যাজিস্ট্রেট পাঠালে আমরা থানা পুলিশ সাহায্য করব। তিতাস কর্তৃপক্ষ মামলা
করলে আমরা আইনী ব্যবস্থা নেব।
সিভিল টিম চলছেই : সিভিল পোশাকে দায়িত্ব পালন না করার জন্য ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তারা একাধিকবার কড়া নির্দেশনা জারি করলেও তা পাত্তা পায় না আশুলিয়ায়। থানার কয়েকজন পুলিশ কর্তা
সিভিল টিমের তৎপরতায় আখেরি বাণিজ্য চালিয়েই যাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রাতে সিভিল টিমের দায়িত্ব
পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তারা নিরীহ লোকদের আটক করে মাদক ও নাশকতা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয়
দেখিয়েও হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা।
রাত হলেই ‘হুঁশিয়ার-সাবধান’ : কয়েক রাত ধরে আশুলিয়ার গ্রামে গ্রামে প্রতিনিয়ত চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেই
চলছে। আর এতে নিরুপায় হয়ে এলাকাবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পরামর্শে চোর-ডাকাত প্রতিহত করতে নিজেরাই
দলবেঁধে লাঠিসোঁটা নিয়ে সারা রাত গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন। গ্রামবাসীর দাবি, প্রতি রাতে চুরি-ডাকাতির বিষয়টি
আশুলিয়া থানা পুলিশকে অবগত করা হলেও তারা অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। আর এতে করে
পুলিশ প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। সরেজমিন আশুলিয়া থানাধীন কলতাসুতি,
নলামসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে যুবকরা হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে
পয়েন্টে জড়ো হতে শুরু করেন। এরপর ১০ জন করে একেক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা গ্রাম-মহল্লা, বাজার-
দোকানপাট পাহারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাহারা চলাকালে তাদের হুঁশিয়ার-সাবধান ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে গ্রামগুলো।
সেসব এলাকার বাসিন্দারা পুলিশের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পান না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে, পত্রিকার পাতা
খুললেই আশুলিয়ায় কোন না কোন স্থানে লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। চলতি জানুয়ারীর ২য়
সপ্তাহে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল থেকে তানজু সহ দুটি লাশ উদ্ধার করেছে থানা পুলিশ।
এরকম প্রায়ই বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ঘটনায় মৃত্যু ব্যক্তিদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ জানিয়েছেন
স্থানীয়রা। উক্ত ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় মামলাতো দুরের কথা অনেকেই প্রভাবশালী চাঁদাবাজ ও
পুলিশের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না বলে সূত্রে জানা যায়।