ঢাকার সাভার আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে ইটভাটার ট্রাকে এক মাসে বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ জন ব্যক্তি
নিহত হয়েছেন। এ সময়ে প্রায় ২৫ জন আহত হন।
জানা গেছে, ইটভাটার মাটি বহনকারী ট্রাক বেপরোয়া গতিতে চলায় এসব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা
জেলার আনাচে-কানাচে বিভিন্ন কাঁচা ও পাকা রাস্তা এবং মহাসড়কে ইটভাটার ট্রাক চলাচলে সড়কগুলো ভেঙে
একদম অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক রাস্তার বেহাল অবস্থা এ যেন দেখার কেউ নেই। সুত্র জানায়, অন্যদিকে
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অনেক ইটভাটা চালাচ্ছেন অনেকেই, ইটভাটার মালিকরা কয়লা দিয়ে ইট না
পুড়িয়ে বিভিন্ন গাছ দিয়ে ইট পুড়াচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলে কথিপয় কর্মকর্তা এসব ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে
মোটা অংকের চাঁদা নিয়ে থাকে এর কারণে ইটভাটার মালিকরা তাদের ইচ্ছা মতো অনিয়ম করে ইটভাটা
পরিচালনা করতে পারছে। এসব ইটভাটার মাটি সরবরাহ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কাগজপত্রবিহীন অবৈধ ট্রাক। আর
এসব ট্রাক বেপরোয়া ভাবে চালায়, এর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। ট্রাকের চালকরা
অধিক ট্রিপ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় ট্রাক বেপরোয়া ভাবে চালায় বলে, তথ্য মতে শুধু ধামরাইয়েই গত এক
মাসে ৯ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঘাতক ট্রাক। এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধায় বেসরকারী টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের ঢাকা জেলা প্রতিনিধি ও ধামরাই প্রেসক্লাবের
সাবেক সভাপতি লোকমান হোসেন তার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা-আরিচা
মহাসড়কের জয়পুরা বাসস্ট্যান্ডে গেলে দঃ পাশ থেকে উত্তর পাশে আসার সময় বেপরোয়া গতির মাটিবহনকারী
একটি ট্রাক চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় সাংবাদিক লোকমানের মাথায় আঘাত লাগে এবং তার
হাতের একটি আঙ্গুল কেটে যায়। এ সময় স্থানীয়রা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢুলিভিটায় সেফ লাইফ
হাসপাতালে ভর্তি করেন। সাংবাদিক লোকমানের গাড়িটিও ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ওই সড়কদুর্ঘটনায়।
ধামরাইয়ের স্থানীয়রা জানান, গত ১৭ জানুয়ারি কালামপুর-সাটুরিয়া সড়কের নান্দেশ্বরী এলাকায় মাটিবহনকারী
একটি ট্রাক ইয়াকুব আলী ও আবদুর সাত্তার নামের দুই মোটর সাইকেল আরোহীকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই
ইয়াকুব আলী নিহত হন। এর পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান
সাত্তার। গত ১৫ জানুয়ারি গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে দুই মোটর সাইকেল আরোহীকে
মাটিবহনকারী ট্রাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই নববধু শারমিন নামে একজন নিহত হন। আহত হন নববধুর স্বামী
জুয়েল হোসেন। ১০ জানুয়ারি বাথুলী বাসস্ট্যান্ডে ইটভাটার শ্রমিক আবদুল জলিল, কাঠমিস্ত্রি বিল্লাল, ৯
জানুয়ারি শ্রীরামপুরে স্কুল ছাত্র পারভেজ হোসেন, একই দিনে ডেমরানের মাদ্রাসার ছাত্র নাইম হোসেন, ৩০
ডিসেম্বর বাসনা এলাকার সাটুরিয়া রাধানগর গ্রামের প্রতীক সিরামিকের শ্রমিক আবদুল গফুর, ২৯
ডিসেম্বর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ডাউটিয়া ব্রীজের পাশে মাটিবহনকারী ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই
নিহত হন রাজবাড়ী জেলার নুরে আলম নামের এক ব্যক্তি। এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ২৫ জন ব্যক্তি গুরতর আহত হয়েছেন
বলে জানা যায়।
সরেজমিনে জানা যায়, ধামরাই, সাভার আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় পাঁচ শ’(৫০০) ইটভাটা রয়েছে। এসব
ইটভাটার মাটি, ইট, কয়লা, গাছসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা-নেওয়ার জন্য প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত
প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার ট্রাক চলাচল করে থাকে বিভিন্ন রোডে। জানা যায়, নান্নার, গোপালপুর, দাইরা,
সূতিপাড়া, বেলীশ্বর, আশুলিয়া, দেপাশাই, ডাউটিয়া, ফুকুটিয়া, বালিথা, বাথুলি, শরীফবাগ ও জয়পুরাসহ
বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা সাংবাদিকদের জানান, স্কুল-কলেজের ছাত্র/ছাত্রী, হাজার হাজার গার্মেন্টস
কর্মীসহ সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ইটভাটার কালো ধোঁয়ায়। দেখা যায়, এসব ইটভার
পাশের সড়ক দখল করে অনেকেই মাটির সত্তুপ করে রাখায় রাস্তায় ব্যাপক ধুলা উড়ে। এই ধুলায় আশপাশের বাসা-
বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গাছপালা নষ্ট হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। কালামপুর গ্রামের আবদুল
মান্নানসহ কয়েকজন সাংবাদিকদের তারা জানান, অতিরিক্ত এসব ট্রাক চলাচলের ফলে ধূলাবাহিত অনেক রোগে
আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই।
উক্ত ব্যাপারে ধামরাই স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. মোয়াজ্জেম খান বলেন, ধূলাবালি
নাকমুখে গেলে তা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে প্রভেশ করে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে যা মৃত্যুর কারণ
হয়ে দাড়াতে পারে । ইটভাটার মালিক নজরুল ইসলাম, নুরু মিয়া আলতাব হোসেন ও আজাহার আলীসহ কয়েক
জনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, প্রতিটি ইটভাটায় প্রতিদিন নুন্যতম ২০টি ট্রাাক মাটি,
ইট, কয়লাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ
সাংবাদিকদের জানান, শুধু ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২শ’টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটায়
প্রায় চার হাজার ট্রাক চলাচল করে। দেখা যায়, দুইশত ইটভাটায় প্রতিদিন চার হাজার ট্রাক বিভিন্ন রোডে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ট্র্রাক মালিক আবদুল করিম জসিম উদ্দিন, ইয়াছিন জানান, প্রিিতটি ট্রাক দিন-রাতে
গড়ে ৮টি করে ট্রিপ দিয়ে থাকেন। এতে দেখা যায়,৩২ হাজার বার যাতায়াত করে থাকে মাত্র দেড়শত কিলোমিটার
সড়কে। অধিক ট্রিপ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালাতে গিয়ে সড়কের মধ্যে মানুষে
জীবন কেড়ে নিতে কুন্ঠাবোধ করে না চালকরা।
উক্ত এলাকার সানোড়া ইউনিয়ন পরিষষদের চেয়ারম্যান খালেদ মাসুদ খান লাল্টু জানান, নতুন ইটভাটা করার জন্য
অনেকেই ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু এলাকাবাসী, জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে
ট্রেড লাইসেন্স দেইনি। ধামরাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, এসব মাটিবহনকারী ট্রাক
চলাচলে রাস্তা ভেঙে পড়ছে, অনেক সড়কের বেহাল অবস্থা। ধামরাই উপজেলা প্রকৌশলী ইউসুফ হোসেন জানান,
ধাামরাইয়ে প্রতিবছরই সড়ক পাকাকরণ ও মেরামত করা হয়, কিন্তু অতিরিক্ত ট্রাক চলাচলের কারণে সড়কগুলোর নাজুক
হয়ে পড়েছে। ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক জানান, বেপরোয়া গতিতে যাতে
ট্রাক না চালানো হয় এ বিষয়ে ট্রাক মালিক সমিতির সাথে আলোচনা করা হবে। উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন,ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য পৌর মেযর ও অন্যান্য
জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশ প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যাতে এরকম প্রাণহানি না
ঘটে। উক্ত ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া
গেছে। এসব ইটভাটার ট্রাক চলাচল করে মিরপুরের গাবতলী, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে
জামগড়া, জিরাবো,পুরাতন আশুলিয়ার দৌড় তিন মাথা মোড়, অন্যদিকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত। এসব রোডে
হাজার হাজার শিল্প শ্রমিকরা জীবনে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপাড় হন।
হেলাল শেখ বিশেষ রিপোর্ট ঃ