ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, গুলশানের ঘটনায় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটি এবং সন্ত্রাসীদের সামর্থ্য প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। দেশের পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটা নতুন এক ভয়াবহ জাতীয় সংকট। এতে শুধু রেঁস্তোরা নয় সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা, আমাদের বিশ্বাস-আস্থা আক্রান্ত হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-, ব্যবস্যা-বাণিজ্য, জীবন-যাপন পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আক্রান্ত হয়েছে।
তিনি দাবি করেছেন, সারা বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। এই সংকটের শেকড় আরো অনেক গভীরে। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। গণতন্ত্রহীন সমাজে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে। কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। এই আতঙ্ক, এই হত্যালীলা থামাতে হবে। বন্ধ করতে হবে রক্তপাত।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোববার বিকেলে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহা সংকটের সময় এখন। গত শুক্রবার রাতে রাজধানী ঢাকায় এক ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। কূটনৈতিক এলাকার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড ও বোমা নিয়ে সন্ত্রাসী দল ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। এই পৈশাচিক সন্ত্রাসী হামলা এবং নারীসহ দেশী-বিদেশী নির্দোষ নাগরিকদের এভাবে হত্যার ঘটনার নিন্দা করার কোন ভাষা নেই। আমরা গভীর বেদনাহত এবং ক্ষুব্ধ। কোনো অজুহাতেই শান্তিপ্রিয় নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা সুস্থতার লক্ষণ নয়। এই বিকারগ্রস্ততার প্রতি আমরা তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও শংকিত। কারণ এই ঘটনায় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটি এবং সন্ত্রাসীদের সামর্থ্য প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। আমরা এর আগে সন্ত্রাসীদের চোরাগোপ্তা হামলার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু এখন তা আর চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ আমাদের এই শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশে ভয়াবহ সন্ত্রাসের দানব গোপনে বেড়ে উঠেছে। তারা এখন পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই ভয়ংকর ছোবল হানছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যমান শত্রুর তুলনায় অদৃশ্য শত্রুর হামলা মোকাবিলা এবং তাদের দমন করা অনেক কঠিন। এই কথা জানি বলেই আমরা এতোটা উৎকণ্ঠিত।
খালেদা বলেন, সন্ত্রাসীরা ইতালীর ৯ জন, জাপানের ৭ জন এবং ভারতীয় একজন নাগরিক সন্ত্রাসীদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে অসহায় মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এই বিদেশি নাগরিকরা পোশাক শিল্পের ক্রেতা হিসাবে এবং ব্যবসা, চাকরি ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। কোন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলা ও নিরপরাধ মানুষের হত্যাযজ্ঞকে মেনে নিতে পারেনা।
ভৌগলিক ও রাষ্ট্রীয় গণ্ডি পেরিয়ে সন্ত্রাস আজ বিশ্বের দেশে দেশে রক্ত ঝরাচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও আজ সন্ত্রাসের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত। এটা আমাদের জন্য নতুন এক ভয়াবহ জাতীয় সংকট। শুক্রবার রাতের ঘটনায় শুধু একটি রেস্তোরাঁ নয়, সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা, আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবস্যা-বাণিজ্য, জীবনযাপন পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই সকলের মিলিত প্রয়াসে আমাদেরকে এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সে দেশের সরকার ও জনগণের। বর্তমানে আমরা সন্ত্রাসের যে চিত্র দেখছি সেটা নিছক আইন-শৃংখলাজনিত মামুলী কোনো সমস্যা নয়। কেবল আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান দিয়ে এই সন্ত্রাস মোকাবিলা করা যাবেনা। এই সংকটের শেকড় আরো অনেক গভীরে। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। এই বিষয়টির দিকে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সচেতন হবার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রহীন দেশে, স্বৈরাচারী শাসন, অসহিষ্ণু রাজনীতি, দমন-পীড়নের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অধিকারহীন সমাজ, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য-বঞ্চনা এবং সুশিক্ষার অভাব ক্রমাগত চলতে থাকলে সেখানে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই কারণগুলো দূর না করলে সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায়না। আমি মনে করি জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কেবল গণতান্ত্রিক পরিবেশেই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে বলে জানান খালেদা জিয়া।
এসময় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু শুক্রবার রাতের ঘটনাই নয়। সারা বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, ধর্মগুরু ও যাজক, ভিন্নমতের লেখক প্রকাশক-ব্লগার, খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আমাদের সযত্নে লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য। কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। এই আতঙ্ক, এই হত্যালীলা থামাতে হবে। বন্ধ করতে হবে রক্তপাত।
সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্যগড়ে তুলে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।