রাজধানীতে দ্বিতীয় দিনের মতো সোমবার ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেটলক’ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অভিযানের কারণে আগের দিনের মতোই সব বাস ‘লোকাল’ হিসেবে চলেছে; তবে যাত্রীদের কাছ থেকে আগের মতোই আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। অনেক বাসে ছিল না ভাড়ার তালিকা।
এ ছাড়া অভিযানের কারণে অনেক বাস রাস্তায় না নামায়; যান সঙ্কটে বিভিন্ন বাসে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের। এতে তাদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন নারীরা।
তা ছাড়া ভাড়া নিয়ে বচসায় বিভিন্ন স্থানে যাত্রীরা মারধরের শিকার হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন সমকাল ও একাত্তর টিভির দুজন সাংবাদিক।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ী, আসাদগেট, বিমানবন্দর ও রমনা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানের দ্বিতীয় দিন মামলা হয়েছে ১১৯টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে তিন লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে দুই বাসচালককে। জব্দ করা হয়েছে একটি গাড়ি; ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে আরেকটি।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় অব্যাহত সরেজমিনে সদরঘাট থেকে ধামরাই পর্যন্ত চলাচলকারী ‘স্বজন পরিবহনের’ একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-১৫২১) দেখা যায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ডেকে ডেকে যাত্রী তোলার সময় হেলপার বলছেন, যারা পল্টন থেকে উঠেছেন, তারা শাহবাগে নামলে ১৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে আর প্রেস ক্লাবে নামলে দিতে হবে ১০ টাকা। অথচ এ পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া সাত টাকা। শুধু স্বজন নয়, সদরঘাট থেকে মিরপুর রুটে চলা ‘শিকড় পরিবহন’, মতিঝিল থেকে মিরপুর রুটের ‘বিকল্প পরিবহন’, সদরঘাট থেকে মিরপুর-১২ রুটের ‘ইউনাইটেড পরিবহন’, সদরঘাট থেকে মিরপুর-১০ রুটের ‘বিহঙ্গ পরিবহনে’ও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়।
যাত্রীরা অভিযোগ করেন, ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধ হলেও বাসগুলো আগের মতোই অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। বাসে ওঠার আগেই গন্তব্য জেনে নিয়ে শর্ত দিচ্ছে, ভাড়া কত দিতে হবে! চুক্তি করেই তাদের বাসে তোলা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া নিলে জরিমানা চলতে থাকবে। অভিযান অব্যাহত আছে। কোনো যাত্রী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে।’
সাংবাদিক লাঞ্ছিত
এদিকে, ভাড়া নিয়ে বচসায় বিভিন্ন স্থানে যাত্রীরা লাঞ্ছিত হয়েছেন। সমকালের স্টাফ রিপোর্টার ইন্দ্রজিৎ সরকারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তিনি জানান, পেশাগত দায়িত্ব পালনে ‘নিউ ভিশনের’ বাসে ফার্মগেট থেকে মিরপুর যাচ্ছিলেন। পথে আসাদগেটে বাসটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ধরা পড়ে। বিভিন্ন অভিযোগে বাসটিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল সালাম। বাসটি দীর্ঘ সময় থেমে থাকায় ইন্দ্রজিৎ হেলপারের কাছে ভাড়া ফেরত চান। ভাড়া ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই তাকে মারধর করে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সুরাহা চাইলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ‘ইতিহাস পরিবহনের’ পরিচালক রিপন মোল্লা সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ভূঁইয়া হুমায়ুন কবির তপনের নেতৃত্বে পরিবহন মালিকদের একটি ভিজিলেন্স টিম আসাদগেটে ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ইন্দ্রজিৎ সরকারকে মারধর করেন।
এ ছাড়া বাসশ্রমিকদের পিটুনিতে আহত হয়েছেন একাত্তর টিভির প্রযোজক ও সংবাদ উপস্থাপক আতিক রহমান।
রাস্তায় নামছে না বাস
অভিযানের কারণে সোমবারও অনেক বাস রাস্তায় নামেনি। যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাই বিকেলে অফিস ছুটির পর চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা, বিশেষ করে নারীরা।
একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সানোয়ার রাসেল জানান, বিকেল ৫টায় অফিস ছুটির পর পল্টন মোড়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারেননি। মতিঝিল, জিপিও থেকে যেসব বাস আসে, তার সবই ছিল যাত্রীবোঝাই। পল্টন থেকে যারা উঠেছেন, তারা বাদুরঝোলা হয়ে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন।
জাকিয়া বেগম নামের এক যাত্রী সন্ধ্যায় টেলিফোনে জানান, ভিড়ের কারণে প্রেস ক্লাবের সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি বাসে উঠতে পারেননি। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন আগে থেকেই পূর্ণ ছিল। বাসে উঠতে চাইলে হেলপার সরাসরি জানিয়ে দেয়, ‘লেডিস সিট খালি নাই।’ পরে তিনি রিকশায় ঘুরপথে বাড়ির উদ্দেশে রওনা করেন।
বাস সঙ্কট সম্পর্কে ‘বসুমতি পরিবহনের’ পরিচালক খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, ‘যাত্রীদের ঝামেলা’র কারণে চালক-হেলপাররা গাড়ি চালাতে চাইছেন না।’
‘হিমাচল পরিবহনের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইয়েদুল ইসলাম দাবি করেন, ‘যাত্রীরা ঠিকমতো ভাড়া দেয় না। সরকার নির্ধারিত ভাড়া চাইলে হেলপারকে মারধর করে, গালাগাল করে। তাই অনেক মালিক বাস বের করতে পারছেন না।’
তবে বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, ‘কেউ গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমাদের অনুরোধ, যাত্রীরা যেন সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত না দেয়।