আব্দুল আউয়াল ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি।
“এপ্রিল মাস এলেই সাংবাদিকরাই আমাদের খোঁজ নিতে আসে, সারা বছর চলে যায় কেউ খোঁজ খবর রাখে না”। সরকার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করছে। কত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে অনেকে। ৭১’ সালে পাক হানাদারের হাতে আমার স্বামী প্রাণ হারালো। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হলেও এখনো মানুষের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জোটেনি বিধবা ভাতাসহ সরকারি সুবিধা। এভাবে কষ্টের কথা গুলো বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা শুখানপুকুরী এলাকায় গণহত্যার শিকার স্বামী গাঠু রামসহ স্বজনহারা শুসিলা বেওয়া।
২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস। এই দিনে আশপাশের ৫শ’ স্বাধীনতাকামী যুবককে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাথরাজ নদীর পাড়ে রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী তাদের হত্যা করার পর বিধবা স্ত্রীদের ওপর চলে সীমাহীন বর্বর নির্যাতন। জাটিভাঙায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসররা একই সঙ্গে তিন হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এখানে।
এখানেই ঘাতকের গুলিতে জগন্নাথপুর, শুকানপুকুরীসহ আশেপাশের প্রাণ হারায় প্রায় তিনশ’ বিধবার স্বামী ও স্বজনরা।
ওই সকল শহীদদের বিধবারা ৪৬ বছর ধরে কাঁদছে। কিন্তু তারা পায়নি তাদের স্বামী হত্যার বিচার ও স্বীকৃতি। এই কান্না বুকের মধ্যে চেপে রেখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের দুঃসহ বোঝাকে। একদিকে স্বামী হারানোর বেদনা আর অন্যদিকে জীবন যাপনের যন্ত্রণা-এ নিয়ে করুন কষ্টে তারা পার করছে দীর্ঘ ৪৬টি বছর।
এদের মধ্যে অনেক বিধবা চিকিত্সার অভাবে পরলোক গমন করেছেন। আর বাকী শহীদের স্ত্রী বর্তমানে দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন অর্ধাহারে অনাহারে।
কর্মক্ষমতা হারিয়ে সেই সব বিধবাদের অনেকেই অর্থের অভাবে চিকিত্সা করাতে না পেরে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা কেউ ভিক্ষে করে, কেউ বা দিনমজুরের কাজ করে নিজের জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
মৃত্যু পথযাত্রী কান্দরি বেওয়া বলেন, “স্বামী হারিয়ে সন্তান নিয়ে সহ্য করেছি অনেক কষ্ট। দুই চোখে জল ঝরতে ঝরতে আজ অন্ধ হয়ে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো মতে দিন পার করছি। তবু সেই রাজাকারদের বিচার চাই। দুই চোখে দেখতে না পারলেও রাজাকারদের বিচার হলে শান্তি পাব।”
জগন্নাথপুরের আশামনি বেওয়া ও জাঠিভাঙ্গা বুড়াশিব গ্রামের ভুটরী বেওয়া অভিযোগ করে বলেন, “একটি বিধবা ভাতার কার্ডে তিন মাস পরপর মাত্র ৯শ টাকা পাই। এ দিয়ে কি সংসার চলে? আর শীতের মৌসুম এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাই একটি কম্বল। সারা বছর আর কেউ কোনো খবর রাখে না।” আমরা শেষ বয়সে একটু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে মরেও শান্তি পাবো।
ঠাকুরগাঁও ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদিউদ্দৌজা বদর জানান, গণহত্যায় শহীদদের বিধবাদের স্বীকৃতির জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সরকার বিষয়টি নজরে নেননি। আমরা সকলে চাই ওই সকল বিধবাদের স্বীকৃতি ও তাদের স্বামী হত্যার বিচার।
এই পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান উল ফেরদৌস নম্র চৌধুরী।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় জাঠিভাঙা গণহত্যার শহীদের পরিবারগুলোর স্বীকৃতি ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবো