হেলাল শেখ ঢাকাঃ
ঢাকার নিকটবর্তী সাভার রানা প্লাজা’র দুর্ঘটনার ৪ বছর পূর্ণ হলো। এক দশকে দেশে নিহত প্রায় ৬
হাজার শ্রমিক। আমাদের মানবতা এখনো মরেনি, প্রকৃত মানবতা আজও বেঁচে আছে কিছু মানুষের
অন্তরে। একজন বিনিয়োগকারী পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তোলেন শিল্প প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকের শ্রম
আর ঘামে তিনি বিশাল বিত্ত আর ভৈভবের মালিক হন। মুনাফার নেশা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। যে
শ্রমিকের মাধ্যমে তার এই বিত্তবৈভব, তার জন্য কোনো দায়িত্ব বোধ থাকেনা মালিকের।
বিশেষ করে কারখানায় অধিকাংশ সময় শ্রমিকদের অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে দেখা যায়। এই অনিরাপদ
পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে ঘটে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। এভাবেই প্রতিবছর বাড়ছে র্দুটনার হার। বাড়ছে
আহত ও নিহত শ্রমিকের সংখ্যা। বিভিন্ন সংস্থা ও পত্রিকার তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে গত এক দশকে
নিহতের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ-যা সংখ্যায় প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি হবে। নেপথ্য কারণ হিসেবে গবেষকরা
বলছেন, অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার কোনো কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা না হওয়া, শ্রমিকের নামমাত্র কিছু টাকা
দেওয়া, অতীতে ঘটে যাওয়া বড় দুর্ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়া ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া,
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও আইন অনুযায়ী কারখানা তৈরি না হওয়া। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের
(বিলস) তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালে ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর মেহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন আবছার খান
মার্কের্টেও দোতলায় স্মার্ট এক্সপোর্ট পোশাককলে অগ্নি দুর্ঘটনায় ৮ শ্রমিক নিহত হন, যা ছিলো
ওই বছরের বড় দুর্ঘটনা।
এর পর বাকরুদ্ধ জাতি, ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল “রানা প্লাজা ট্রাজেডি” বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত এই
দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয়
প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে। আহতদের মধ্যে কারো হাত নেই, পা নেই, যাদের না মাত্রায় আহত অবস্থায়
উদ্ধার করা হয়। অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে আজও তারা অবহেলায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বলুনতো
বিবেকবান মানুষ কিভাবে শ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটাবেন? এখনও অনেক শিল্প কারখানায় মাসের পর মাস
বেতন বকেয়া থাকে। বিভিন্ন ভাবে শ্রমিকদের নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে বিলসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ৩০১ জন। ২০১২ সালের চিত্র
ছিল বলতে গেলে ভয়াবহই। ওই বছর নিহত হন ৯০৬ জন শ্রমিক। এ সময় আহত হয়েছেন ১ হাজার ১০৮ জন,
নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৪৮, ধর্ষিত হয়েছেন ১৩ জন নারী। অপহরণ ৩৮২ ও আত্মহত্যা করেছেন ২৪
শ্রমিক। ২০১১ সালে মৃতের এই সংখ্যা ছিলেলা ৮৮৯ জন। এ বছরে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন প্রায় এক
হাজার ২৩৫ জন শ্রমিক। ২০১০ সালে ৭০৯ জন। ২০০৯ সালে ৩৭৮, ২০০৮ সালে ৫৪৭, ২০০৭ সালে ৪৬৫, ২০০৬
সালে ৯৭৪, ২০০৫ সালে ৪৮০, ২০০৪ সালে ১৮৮, ২০০৩ সালে ২৫১, এবং ২০০২ সালে ১৬৮ জন শ্রমিক
জীবিকাস্থলে মারা যান। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২০
লাখ শ্রমিক জীবিকাস্থলে দুর্ঘটনায় মারা যান। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ ও কর্মহীন হয়ে পড়েন প্রায় ১২ লাখ
শ্রমিক। পেশাগত রোগে আক্রান্ত হন ১৫ কোটিরও বেশি শ্রমিক।
বিশেষ করে বিলসের মতে, সরকারি হিসাবে বরাবরই নিহতের সংখ্যা কম দেখানো হয়। আর যেহেতু টাকা
পয়সা দেয়ার কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে মালিকদের দিক থেকেও দুর্ঘটনার বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার
প্রবণতা থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হলেও এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
কারণ সব ধরণের দুর্ঘটনার সংবাদ অনেক সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। বর্তমানে ২০১৭ সাল এর আগে
ও পরে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে যা গনমাধ্যমে অনেক সংবাদ আসেনি। ১ মে দিবসে কিভাবে শ্রমিকদের
মুখে হাসি ফুটাবে ? সাভার আশুলিয়ার কয়েক হাজার শ্রমিক বকেয়া বেতন না পেয়ে রাস্তায় নেমে
এসেছেন। বাসা ভাড়া, দোকান বাঁকির টাকা না দিতে পেরে দিশেহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ
যেন দেখার কেউ নেই।