সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির
অভিযোগে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব,পাউবোর
কর্মকর্তা,প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও ঠিকাদারদের
বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায়
সুনামগঞ্জের সিনিয়র স্পেশ্যাল জজ আদালতে ১২/২০১৭নং স্পেশ্যাল
মামলাটি দায়ের করা হয়। জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারন
সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল হক বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের
করেছেন। মামলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ
কামাল,পাউবোর ১৫জন কর্মকর্তা,৩৯টি পিআইসির ৭৮জন
সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকসহ মোট ১৪০জনকে আসামী করা
হয়েছে। মামলার বাদী আবদুল হক এজহারে ত্রাণ ও দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামালকেও আসামী করার
বিষয়টিও উল্লেখ করেন। ত্রাণ সচিব ফসলহানির ঘটনার সময় গত ১৯
এপ্রিল সুনামগঞ্জে আসেন। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক
সভায় তিনি বলেন, দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন
আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা আছে, কোনো এলাকার
অর্ধেকের ওপরে জনসংখ্যা মারা গেলে ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা
ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায় তাদের
কোনো প্রকার জ্ঞানই নেই।’ ত্রাণ সচিব অবজ্ঞার সুরে আরও বলেন,
‘কিসের দুর্গত এলাকা, একটি ছাগলও তো মারা যায়নি’-বাদী
অভিযোগে এই মন্তব্যও উল্লেখ করেছেন।
সাক্ষী করা হয়েছে বর্তমান জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল
ইসলাম,সাবেক জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামসহ জেলায়
কর্মরত ২৯জন আইনজীবি ও সাংবাদিককে। বাংলাদেশ দন্ডবিধি
আইনের ১২০-বি/৪০৯/১৬৬/১৬৭/১০৯/৫১১/৫০৫(এ) ধারার পাশাপাশি
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭ ধারা ও দুর্নীতি
প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় দায়েরকৃত মামলাটি
আদালতে শুনানী করেন এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী।
বিদায়ী বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মোঃ মুজিবুর রহমান
মামলাটি গ্রহন করেন। এসময় সিনিয়র আইনজীবি
এডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়া,এডভোকেট আফতাব উদ্দিন
আহমদ,এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুসহ প্রায় অর্ধ
শতাধিক আইনজীবী মামলার শুনানীতে অংশ নেন। সুনামগঞ্জের
বিদায়ী বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মোঃ মুজিবুর রহমান মামলাটি
গ্রহন করেন।
এর আগে গত ২রা জুলাই সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় পানি
উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর প্রধান কার্যালয়ের সহকারী
পরিচালক মোঃ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা নং ২ (জিআর
১৯৫/২০১৭) দায়ের করেন। মামলায় ১৫ জন কর্মকর্তার পাশাপাশি ৪৬
জন ঠিকাদারকে আসামী করা হয়।
উল্লেখ্য ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলায় শতভাগ ফসলহানী হলেও
এখন পর্যন্ত তথাকথিত কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি
(পিআইসি) এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পানি উন্নয়ন
বোর্ড। ইতিপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশন শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও পিআইসির
সাথে জড়িতরা ছিল ধরাছোয়ার বাইরে। তবে ২৪৬টি পিআইসির
মধ্যে মাত্র ৩৯টি পিআইসিকে মামলার আওতায় আনা হলেও বাকী
২০৭টি পিআইসিকে বাদ দেয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন
কৃষকরা। জানা যায়, জেলার মোট ৪২টি হাওরে সুনামগঞ্জ
পাউবোর আওতাভূক্ত বাঁধের আয়তন হচ্ছে ১৫০০ কিলোমিটার। এর
মধ্যে হাওর এলাকার আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন
প্রকল্পের আওতায় ৩৭টি হাওরে মোট ৪৯৪ কিলোমিটার বাঁধের
কাজ করার জন্য ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। বরাদ্ধকৃত এ
অর্থের ২৫% টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে আগাম প্রদান
করেছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। ২০১৬-২০১৭ইং অর্থ বৎসরে কাজের
বিনিময়ে টাকা কাবিটা প্রকল্পের আওতায় মাত্র ৮৪ কিলোমিটার
বাঁধ মেরামতের জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয় ২১ কোটি টাকা। ৫ সদস্য
বিশিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) এর মাধ্যমে কাজ
শুরু করার পুর্বেই প্রত্যেক পিআইসিকে ৫০% টাকা বরাদ্ধ দেয়
পাউবো কর্তৃপক্ষ। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পার্সেন্টিজ
পায় নির্বাহী প্রকৌশলীসহ পাউবোর ৩ জন উপবিভাগীয়
প্রকৌশলী,১০জন সেকশন অফিসারসহ দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা।
২৮ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে ২৪৬টি পিআইসি বাঁধের কাজ শেষ করার
কথা থাকলেও কোন পিআইসিই এসময়ে কাজ শুরু করেনি। ফলে
অকাল বন্যা,পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টির পানি অতি সহজেই কোন প্রকার
বিনা বাধায় হাওরে প্রবেশ করে ২ লাখ ২০ হাজার ৮ শত ৫০ হেক্টর
বোর জমির ফসল তলিয়ে নিয়ে গেছে।
জেলার সিভিল সোসাইটির লোকজন দাবী করছেন জেলা
আইনজীবী সমিতির মামলায় মাত্র ৩৯টি পিআইসিকে
আসামী করে বাকী ২০৭টিকে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া
ঠিকাদারকে আসামী করা হলেও তাদের ভাগীদারদের (অংশীদার)
আসামী করা হয়নি। যেখানে শতভাগ দুর্নীতি হয়েছে সেখানে
পিআইসির একটা বড় অংশকে মামলা থেকে বাঁদ দেয়াটা ঠিক
হয়নি। সুনামগঞ্জবাসী অবিলম্বে ঠিকাদারদের দুর্নীতির
সহযোগী ভাগীদার ও অপরাপর দুর্নীতিবাজ পিআইসিদের
বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পাশাপাশি তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সুনামগঞ্জের সিভিল সোসাইটির লোকজন দাবী করেছেন
কেবলমাত্র ঠিকাদারই নয় পাউবোর বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের সাথে
সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে ঠিকাদারদের স্থানীয় ভাগীদার অর্থাৎ
সহযোগীরা। মামলায় অস্থানীয় ভাগীদার অর্থাৎ একজন
সহযোগীকে আসামী করা হলেও স্থানীয় কোন সহযোগী বা
ভাগীদারদেরকে আসামী করা হয়নি।