একটা সময় সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সুবীর নন্দীদের দাপটে প্লেব্যাক হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সংগীতের সবচাইতে জনপ্রিয় ও বড় মাধ্যম। ধারাবাহিকভাবে তারা কয়েক যুগ দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। সত্তর ও আশির দশকে তাদের হাত ধরেই বাংলা গান অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। এর পরে এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, কনকচাঁপা, আগুনরা দীর্ঘ সময় ধরে চলচ্চিত্রের গানে ধারাবাহিক সফলতা পেয়েছেন। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। তাকে প্লেবাকের মুকুটহীন সম্রাটও বলা হয়। অন্যদিকে রুনা ও সাবিনা পরবর্তীদের মধ্যে কনকচাঁপা নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন সফল প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন নায়িকার লিপে তার গান উপভোগ করেছেন মানুষ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্লেব্যাকে যেন এক ধরনের খরা যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে না কোন তারকা। অনেকে অডিওতে সফলতা পেলেও প্লেব্যাকে ব্যর্থ। আবার যারা চলচ্চিত্রের গানে সফলতা পাচ্ছেন তারা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছেন না। আর এ কারণেই এন্ডু্র কিশোর ও কনকচাঁপা পরবর্তী সময়ে এমন কোনো তারকা তৈরি হয়নি যারা রাজকীয়ভাবে প্লেব্যাকে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। বিচ্ছিন্নভাবেই কেবল সফলতা এসেছে। এদিক থেকে এস আই টুটুল চলচ্চিত্রে শুরুটা করেছিলেন ভালো। একে একে বেশ কিছু ছবিতে হিট গান উপহার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে সেই ধারাবাহিকতায় ভাটা দেখা দিয়েছে। যার ফলে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করলেও খুব বেশি দূর এগুতে পারেননি এ সংগীত পরিচালক-শিল্পী। অন্যদিকে হালের হাবিব ওয়াহিদ, অর্নব, হৃদয় খান, আরফিন রুমিরাও চলচ্চিত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। কিন্তু অডিও নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে পুরোপুরি চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করা হয়ে উঠেনি তাদের। তাছাড়া তাদের সম্মানী অনেক বেশি হওয়ায় অনেক পরিচালক আগ্রহী হচ্ছেন না তাদের দিয়ে গান করতে। অন্যদিকে নারী কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে ন্যান্সি চলচ্চিত্রের গানে অনেকটাই একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি তার সম্মানী বেশি হওয়ার ফলেও সব পরিচালক আগ্রহ পান না এ তারকাকে নিয়ে কাজ করতে। কনা অনেক ভালো একটি সম্ভাবনার তৈরি করেছেন চলচ্চিত্রে। এরই মধ্যে অনেক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিলেও জনপ্রিয় গান খুব একটা নেই তার। এদের বাইরে ইমরান, কিশোর, পুলক, সাব্বির, লেমিস, মিমি, পূজা, নাওমিরাও চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিচ্ছেন নিয়মিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই প্লেব্যাকের ক্ষেত্রে নিজেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিংবা ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ করে তুলতে পারেননি। যার ফলে প্লেব্যাক থেকে এন্ড্রু কিশোর কিংবা কনকচাঁপাদের মতো বলিষ্ঠ সম্ভাবনাময় শিল্পীও বের হয়নি কেউ। বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যস্ততা, একাগ্রতার অভাব, অতি সম্মানী হাঁকানোসহ বেশ কিছু কারণেই চলতি সময়ে প্লেব্যাকে তারকা কণ্ঠশিল্পী তৈরি হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংগীতবোদ্ধারা। এ বিষয়ে বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান বলেন, এখন সবাই গান করছে সাময়িক জনপ্রিয়তার জন্য। এভাবে গান করলে গানই দীর্ঘদিন টিকবে না! আর শিল্পীর টিকে থাকতো দূরের কথা। গান মনের খোরাক। তাই কথা, সুর, সংগীত ও গায়কির একটি অপূর্ব সম্মিলন প্রয়োজন। আগে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের গানের প্রতি শিল্পী
কিংবা সংগীতসংশ্লিষ্টদের ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসার বন্ধনটা ছিল খুব শক্ত। আর এখন হয়ে উঠেছে সব যান্ত্রিক। কোনো আবেগ কিংবা ভালোবাসা নেই। সর্বোপরি গানের প্রতি দরদ যদি না থাকে তবে চলচ্চিত্রের গান কেন কোনো ক্ষেত্রেই পূর্ণ সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে বরেণ্য সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, আগে একটি গান তৈরি হতো গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, শিল্পী,
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পীদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে দু-তিনদিন প্র্যাকটিস হতো। এরপর রাতব্যাপী আমরা গান রেকর্ডিং করতাম। এর মাধ্যমে একটি সুন্দর গান বের হয়ে আসতো। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে সব সহজ হয়েছে ঠিক কিন্তু গান হয়ে গেলে তরল। সবার মধ্যে খুব তাড়াহুড়ো কাজ করে। স্টুডিওতে ডেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে গান কমপ্লিট হয়ে যাচ্ছে। মায়া, মমতা ও ভালোবাসা যদি কাজের প্রতি না থাকে সে কাজ কখনোই ভালো হয় না। আর এ কারণেই চলচ্চিত্রে কোনো শিল্পী শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারছেন না।