অনলাইন ডেস্কঃ-
কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার বলেছেন, তাঁকে জোর করে ভয় দেখিয়ে পুলিশ তাঁর কাছ থেকে জবানবন্দি নিয়েছে। আজ শনিবার রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ বাসায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
শুরুতেই ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি ডান চোখে আবছা ছায়া ছাড়া কিছুই দেখি না। আমার দুই চোখেই ছানির অপারেশন হয়েছে। আমার বয়সের কারণে দুই চোখে কিছু পড়তে বা লিখতে গেলে চোখ শুকিয়ে যায়। ডায়াবেটিক হবার কারণে এটা সম্প্রতি বেড়েছে। গত ৩ জুলাই ২০১৭ আমি ভোরে কম্পিউটারে লিখতে গিয়ে দেখি আমি চোখ খুলতে পারছি না, শুকনা। লেখা কিছুই পড়তে বা লিখতে পারছি না। সব আবছা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থা হলে ওষুধ কেনার জন্য একটি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসিতে ওষুধ কেনার জন্য নামি। এই সময় তিনজন লোক আমাকে ঘিরে একটি মাইক্রোবাসে জোর করে তুলেই আমার চোখ বন্ধ করে ফেলে।’
ফরহাদ মজহার আরো বলেন, ‘সেই সময় ফোন আমার হাতে, স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ডায়াল করা অবস্থা থাকায় প্রথম ফোন আমি ভাগ্যক্রমে আমার স্ত্রীকে করতে পারি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ যা কিছু করতে বলে আমি তা করি। যেখানে তারা আমাকে ছেড়ে দেয় আমি তা চিনি না। আমি বুঝতে পারি তারা আমার ওপর নজরদারি রেখেছে এবং নির্দেশমতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গাড়িতে উঠলে গাড়িতে তারা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়। আমি মৃত্যুভয়ে ভীত, বিধ্বস্ত ও শারীরিক অসুস্থতায় নির্জীব হয়ে পড়ি।’
কবি বলেন, ‘শোরগোল শুনে আমি জেগে উঠি, কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে আবার নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। আমাকে মারবার জন্য নামানো হচ্ছে ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, কিন্তু সাদা পোশাকের কিছু ব্যক্তি র্যাবের দিকে বন্দুক তুলে শাসিয়ে আমাকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বচসা ও তর্কাতর্কি হয়। কিন্তু র্যাব ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাদের গাড়ি ওঠায় এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো র্যাবের গাড়ি থেকে আমাকে বারবার জোর করে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। অপহরণকারীরা তখনো এলাকায় থাকতে পারে ভেবে র্যাব আমাকে খুলনায় নিয়ে আমার চিকিৎসা ও বিশ্রামের পাশাপাশি তদন্ত করতে চাইলেও কে বা কারা র্যাবের গাড়ির দুই দিকে রাস্তার রাতের ট্রাক থামিয়ে দুই দিকে পথ রোধ করে এবং র্যাবের গাড়িসহ আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে আসে। পরে বলা হয়, এটা অভয়নগর থানা।’ তিনি বলেন, “আমি গুমের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তি (Survivor) হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জোর করে র্যাবের গাড়ি থেকে নামানো হয়, আমার সঙ্গে তারা দুর্ব্যবহার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে আমি ‘বিনোদন’-এর বেরিয়েছি এবং তাদের কাছে ভিডিওসহ অন্যান্য প্রমাণ আছে। এরপর তারা মধ্যরাতে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ এবং অবিলম্বে চিকিৎসা দরকার বলা হলেও আমাকে ক্যামেরাসহ কিছু লোকের সামনে দাঁড় করানো হয়, সাংবাদিকদের সামনে আমি বিনোদনের জন্য স্বেচ্ছায় বেরিয়েছি বলে স্বীকার করবার জন্য প্রচণ্ড চাপ দেয়, অনেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পুলিশের একটি গাড়িতে নিয়ে আমাকে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে পুলিশ ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। সারা পথে নানানভাবে আমি মানসিক নির্যাতন ভোগ করি।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং বারবার বলা সত্ত্বেও আমাকে আমার পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। বহুক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি অফিসে হতভম্ব, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। আমি মাননীয় আদালতকে প্রচণ্ড বিভ্রান্ত অবস্থায় শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, আমার ভীতি ও ট্রমা এখনো কাটেনি, ডিবি অফিস আমাকে দিয়ে যা লিখিয়ে নিয়েছে আমি তাই আপনাকে দিচ্ছি। এরপর তাঁর সদয় অনুমতি নিয়ে তাঁর কক্ষের সোফায় এলিয়ে পড়ি।’
প্রাবন্ধিক আরো বলেন, “পরে জানতে পারি ও এখন বুঝতে পারি অপহরণকারীরা খুলনা-যশোর সীমান্তের দিক দিয়ে আমাকে সীমান্তের ওপাশে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের কোনো দোষ পাওয়া যায়নি, সীমান্ত পার করে দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতো।’ তাঁর এই উৎকণ্ঠা ন্যায্য এবং তার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে চাই (প্রথম আলো ৫ জুলাই ২০১৭)।”
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ইতোপূর্বে জোরপূর্বক অপহরণের মতো মারাত্মক ও জঘন্য ঘটনার তদন্ত না করে অভয়নগর থানার বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাকে অন্যদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তদন্ত শেষ হবার আগেই পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেস কনফারেন্স করে আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করেন এবং পুলিশের প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করলে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেন। এতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অপহৃত অবস্থায় আমাকে যেসব কাজ করতে আমাকে বাধ্য করা হয় এবং পুলিশের বয়ানে সঙ্গতি ফুটে ওঠে। কিন্তু তারপরও তদন্তের স্বার্থে আমরা চুপ থাকি। জুলাইয়ের ১৮ তারিখে আমাকে আবার তাদের অফিসে ডেকে নেয়। কিন্তু সেখানেও সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে পুলিশের প্রতিবেদন সায় না দিলে আমাদের আরো সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত এবং আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে পুলিশ হুমকি দিতে থাকেন। এতে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকি। আইনি প্রক্রিয়ার স্বার্থে গোয়েন্দা পুলিশ যে প্রতিবেদনই দিক তাকে আইনিভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সত্য-মিথ্যার মীমাংসা আদালতে আশা করে আমরা চুপ থাকি।’
প্রাবন্ধিক আরো বলেন, ‘গুমের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে যাঁরা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা তাদের সাফল্য ও গৌরবকে মারাত্মকভাবে ম্লান করে দেওয়া হলো।