অনলাইন ডেস্কঃ
প্রায় ৭০ দিন পর ছেলে উৎপল দাসকে কাছে পেয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন মা বিমলা দাস। ছেলেকে ফিরে পেয়েই খুশি তিনি। কারো প্রতি তাঁর নেই কোনো অভিযোগ।
অপহরণের প্রায় ৭০ দিন পর ফেরার সুযোগ পেয়ে সাংবাদিক উৎপল দাস প্রথম ফোন করেছিলেন এই গর্ভধারিণী মাকেই।
উৎপল দাসের মা বিমলা দাস বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে আমি এই দুই মাস অনেক কেঁদেছি। আর কোনো মায়ের ছেলে যেন এমন ঘটনার শিকার না হয়—এটাই আমার চাওয়া। আমি কোনো বিচার চাই না, আমি ছেলেকে পেয়েছি এতেই সন্তুষ্ট।’
অন্যদিকে উৎপল দাসের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, ‘ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর আমার কাছে মোবাইলে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেকে দেখে আমি টাকা দেব জানালে পরবর্তীতে তাঁরা আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদেরকে আমরা চিনি না। তাই আমার ছেলে ফিরে এসেছে এতেই আমি খুশি। তার মতো এই পেশায় যারা আছে, তারা সবাই যাতে নিরাপদে সুন্দর থাকে, কেউ যাতে আমার ছেলের মতো এমন বিপদে না পড়ে এটাই আমার প্রত্যাশা।’
সাংবাদিক উৎপল দাস নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রাধানগর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাসের ছেলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট উৎপল। পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রায়পুরা থানার পাশে থানাহাটি এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। বাবা চিত্তরঞ্জন দাস গজারিয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। উৎপল পূর্ব পশ্চিম বিডি ডটকম অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সিনিয়র রিপোর্টার।
এদিকে নিখোঁজ ছাত্রের ফিরে আসার সংবাদে বাড়িতে আজ ছুটে এসেছিলেন রায়পুরার এ কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আলম দুলু। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু জেনেছি উৎপল নিখোঁজ। কিন্তু কারা কী কারণে তাকে নিয়ে গিয়েছিল তা আজও জানতে পারিনি। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এর রহস্য উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।’
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন বলেন, সাংবাদিক উৎপল দাস ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর বাবা বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। উৎপল দাস বাড়িতে ফিরলে পুলিশ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে। অপহরণকারীরা তাঁর কাছে টাকা দাবি করেছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। এই ব্যাপারে তাঁর পরিবারকে সব ধরনের আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে দাড়ি-গোঁফে ঢাকা চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই সেই প্রাণচঞ্চল সাংবাদিক উৎপল দাসকে। চেহারায় ভয়ের ছাপ অনেকটাই স্পষ্ট।
মুক্তি পাওয়ার পর আজ ভোর ৫টার দিকে স্বজনরা সাংবাদিক উৎপল দাসকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার থানাহাটি এলাকার বাড়িতে নিয়ে আসেন।
খবর পেয়ে সকালে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সংবাদকর্মী ও স্থানীয় লোকজনের ভিড়। সবাই জানতে চান তাঁর অপহরণের রহস্য। তবে তেমন কিছুই জানাতে পারেননি তিনি। খুব শিগগিরই তিনি কাজে ফিরে আসবেন বলে জানান।
গত ১০ অক্টোবর ঢাকার ধানমণ্ডি স্টার কাবাবের সামনে মোবাইলে কথা বলার সময় উৎপল দাসকে কে বা কারা মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায়।
এরপর দীর্ঘ ৭০ দিনের মধ্যে মাত্র দুদিন অপহরণকারীরা সাংবাদিক উৎপল দাসের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা তাঁর কাছে টাকা দাবি করলেও টাকার জন্য কোনো চাপ কিংবা শারীরিক নির্যাতন করেনি বলে জানান তিনি।
ফলে তাঁর রহস্যঘেরা অপহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি কারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এর নেপথ্যের কারণ কী তাও তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন।
অপহরণের দিনগুলোতে কেমন ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উৎপল দাস বলেন, ‘তারা একটা টিনশেডের ঘরের মধ্যে আমাকে আটকে রাখে। রাতে প্রচুর শিয়ালের ডাক শোনা যেত, ফলে আমার ধারণা তা গভীর জঙ্গল ছিল। সেখানে চৌকি ছিল না, মেঝেতেই থাকতে হয়েছিল। আর ঘরের ভেতরেই বাথরুম ছিল। সেখানে গোসল করতাম। তারা দরজার নিচ দিয়ে আমাকে খাবার দিত।’
অপহরণকারীদের টাকা দাবির বিষয়ে উৎপল দাস বলেন, ‘তারা দুদিন আমাকে চোখ বেঁধে ঘর থেকে বের করে বলে, এত টাকা আছে তোর কাছে, তুই টাকা দে। টাকা দিলে তোকে ছেড়ে দিব। কিন্তু টাকার জন্য তারা আমাকে কোনো শারীরিক নির্যাতন করেনি।’
ফিরে আসার ঘটনাও বর্ণনা করেছেন সাংবাদিক উৎপল দাস। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তারা আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলে। তিন থেকে চার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমাকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় নামিয়ে দেয়। আমাকে তারা বলে, তোর ফোনে চার্জ আছে, তুই বাড়ি চলে যা। আমি যখন সিএনজি স্টেশনে ঘোরাফেরা করছিলাম, তখন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম গিয়ে আমাকে সিএনজি স্টেশন থেকে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।’
নির্যাতন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে উৎপল দাস বলেন, ‘তারা আমার সঙ্গে বেশি কথা বলেনি। আর যখনই ঘর থেকে বাইরে বের করা হতো, তখনই চোখে কালো কাপড় বাঁধা থাকত। ফলে তাদের কাউকে আমি দেখতে পারিনি। সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার অবস্থান শনাক্ত করে ফেলেছে এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো তারা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।