হেলাল শেখ, সাভার থেকে ঃ-
হলমার্ক গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে গ্রুপটির ২২৭ বিঘা জমি ও কারখানা। পাওনা আদায়ে এ সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সোনালী ব্যাংক। নির্মাণাধীন বেশকিছু ভবনসহ বন্ধকি এ সম্পত্তি বিক্রি থেকে ৪০০ কোটি টাকা আসতে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, হলমার্কের সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রস্তুতি এরই মধ্যে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের কাছে জামানত থাকা জমি চিহ্নিত করার জন্য কানুনগো (উপসহকারী সেটলমেন্ট অফিসার) নিয়োগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। এর মাধ্যমে জামানতের সম্পত্তিতে সরকারি খাসজমি বা অন্যের মালিকানাধীন সম্পত্তি আছে কিনা, তা যাচাই-বাছাই করা হবে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ক্রেতাদের আমরা নিষ্কণ্টক জমি দিতে চাই। এজন্য জামানতের সম্পত্তিতে সরকারি খাসজমি বা অন্য কারো জমি আছে কিনা, সেটি চিহ্নিত করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করছি, নিলামে হলমার্কের কারখানা, নির্মাণাধীন ভবনসহ জমির ভালো ক্রেতা পাওয়া যাবে।
হলমার্ক গ্রুপের নেয়া ঋণের বিপরীতে সব মিলিয়ে সাড়ে সাত হাজার শতক বা ২২৭ বিঘা জমি সোনালী ব্যাংকের কাছে জামানত রয়েছে। ঋণ দেয়ার সময় এসব জমির মূল্য দেখানো হয়েছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ার পর সোনালী ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ কমিটি যাচাই করে এ সম্পত্তির মূল্য হিসাব করেছে মাত্র ৩৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ সম্পত্তি অধিকারে নিতে বিভিন্ন সময় অর্থঋণ আদালতে ১৬টি মামলা করে সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে সবক’টি মামলার রায় সোনালী ব্যাংকের পক্ষে এসেছে। পরে জামানতের সম্পত্তি দখলে নিতে জারি মামলাও সোনালী ব্যাংকের পক্ষে আসায় সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ঋণের তুলনায় জামানতের সম্পত্তির বাজারমূল্য অনেক কম বলে জানান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। তিনি বলেন, ব্যাংকিং নিয়মনীতি উপেক্ষা করেই হলমার্ক গ্রুপকে ঋণ দেয়া হয়েছিল। ২০১২ সালে কেলেঙ্কারির বিষয়টি ধরা পড়ার পর থেকে হলমার্কের সিংহভাগ কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনগুলোও দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। এ অবস্থায় জামানতের সব সম্পদ বিক্রি করেও ঋণের টাকা পুরোপুরি আদায় হবে না। তার পরও আমরা জামানতের সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
হলমার্ক গ্রুপের কারখানা ও সোনালী ব্যাংকের কাছে থাকা জামানতের বেশির ভাগ জমিই সাভারের হেমায়েতপুরে। হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর রোডের তেঁতুলঝোড়া ব্রিজের দুই পাশে হলমার্কের পোশাক কারখানা ও নির্মাণাধীন ভবনগুলোর অবস্থান।
সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার বাম পাশে বেশ কয়েকটি নির্মাণাধীন ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এর কোনো কোনোটির একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হয়েছে। দুটি ভবনের শুধু পিলার পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। ভবনগুলোর পশ্চিম পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী। সবক’টি ভবনেই শ্যাওলা ধরেছে। ভবনের মধ্যেই বেড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। প্রায় ১ ঘণ্টা অবস্থান করেও সেখানে কোনো নিরাপত্তারক্ষী কিংবা সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি ভবনে মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের অবস্থান করতে দেখা যায়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, জমির পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের কাছে হলমার্ক গ্রুপের কারখানার যন্ত্রপাতি ও মালপত্র জামানত ছিল। কিন্তু কেলেঙ্কারির ঘটনায় হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও এমডি তানভীর মাহমুদ জেলে যাওয়ার পর গ্রুপটির কর্মকর্তারা যন্ত্রপাতিসহ কারখানার মালপত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রীত ওই অর্থ হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদের কাছেই গেছে। এছাড়া গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের কাছে জামানত থাকা তৈরি পোশাক, বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাপড় ও সুতাসহ অনেক সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি বিক্রি করে দিয়েছেন হলমার্কের খামারে থাকা প্রায় তিন হাজার গরুও।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে হলমার্কের কারখানাগুলো পরিচালনা করে অর্থ আদায়ের পরামর্শ এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও বিদ্যমান আইনে এর সুযোগ ছিল না। কারণ কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা ব্যাংকের কাজের মধ্যে পড়ে না। সরকার শিল্প বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলমার্কের কারখানাসহ ব্যবসাগুলো পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে সেটি সম্ভব হতো। কিংবা সরকার টাকা পরিশোধের শর্তে হলমার্কের চেয়ারম্যান-এমডিকে জামিন দিলে এক প্রকার সুরাহা করা যেত। কিন্তু বর্তমান আইনি প্রক্রিয়ায় সেটিও সম্ভব ছিল না।
গ্রুপটির জামানতের সম্পত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ার পর পরই হলমার্কের সব সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নিলে ব্যাংকের ঋণের বড় অংশই আদায় করা সম্ভব হতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চেয়ারম্যান-এমডিসহ গ্রুপটির কর্মকর্তারা গ্রেফতার হওয়ার পর হলমার্কের অনেক গাড়ি, যন্ত্রপাতি, গরু চুরি কিংবা লোপাট হয়ে গিয়েছিল। ফলে জামানতের সম্পত্তির মূল্য দিন দিন কমে আসছে। আইনি প্রক্রিয়ায় যতটুকু অর্থ আদায় করা সম্ভব, ততটুকুই আদায় হবে। হলমার্কের ঋণের পুরো অর্থ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা অন্তত আমি দেখছি না। তবে এ কেলেঙ্কারি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেখেশুনে ভবিষ্যতে পথ চলতে হবে। অন্যথায় বারবার এমন কেলেঙ্কারি ঘটতেই থাকবে।
দেশের ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের অন্যতম নিদর্শন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ চক্র। হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও এমডি তানভীর মাহমুদ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
গ্রুপটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে গ্রুপের কারো বক্তব্য জানাও সম্ভব হয়নি।