স্পোর্টস ডেস্কঃ-
আর্জেন্টিনা কি আজ অর্জন-বিসর্জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে?
চারপাশের হৈচৈ আর আশা-নিরাশার দোলাচল দৃশ্যের মূল বার্তা কিন্তু এমনটাই। অর্জন বলতে দেখানো হচ্ছে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠাকে, আর বিসর্জন মানে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়। কিন্তু এ আর্জেন্টিনাই তো ষোলো বছর আগে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছিল। সর্বশেষ তিন আসরে দ্বিতীয় রাউন্ড তো বটেই, নূ্যনতম কোয়ার্টার ফাইনালেও খেলেছে। তাহলে এখন আর বিসর্জন-অর্জনের ভাবনায় উদ্বেগ আর আশা কেন?
উত্তরটা লুকিয়ে লিওনেল মেসিতে। তর্কযোগ্যভাবে চলতি শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় তিনি, ক্লাব ফুটবলে রেকর্ড অজস্র। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচের পর তার অবস্থা এখন ‘হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’র মতো। ক্লাব ক্যারিয়ারের শিরোপার বদলে হলেও দেশের হয়ে একটি বিশ্বকাপ জিততে যার পরম আকুলতা, বিশ্বকাপ না জিতে অবসর না নেওয়া যার কঠিন পণ- তার তো বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া মানে নক্ষত্র খসে পড়া! কেবল মাঠের এই দেনা-পাওনার হিসাবই নয়, মেটানোর আছে প্রথম দুই ম্যাচের ব্যর্থতার পথ ধরে দলের ভেতরে ঢুকে যাওয়া অস্থিরতাকে ঘুম পাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও। তাই তো নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আজ মেসি আর আর্জেন্টিনার জয় দরকার ভীষণভাবে। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে হলে আফ্রিকান প্রতিপক্ষকে হারানোর কোনো বিকল্প নেই। রাত ১২টায় সেন্ট পিটার্সবার্গে শুরু হওয়া এই ম্যাচের সমান্তরালে রোস্তভে চলবে ক্রোয়েশিয়া-আইসল্যান্ড ম্যাচ। নিজেদের জয়ের পাশাপাশি আর্জেন্টিনাকে নজর দিতে হবে ওই ম্যাচেও। হার অথবা ড্র কামনা করতে হবে আইসল্যান্ডের। ‘ডি’ গ্রুপের প্রথম দুটি ম্যাচশেষে আর্জেন্টিনার পয়েন্ট এখন মাত্র এক। এক পয়েন্ট আইসল্যান্ডেরও। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়ার ভাণ্ডারে আছে ছয় পয়েন্ট, নাইজেরিয়ার তিন। আর্জেন্টিনা আজ জিততে পারলে পয়েন্ট হবে চার, নাইজেরিয়া থেকে যাবে তিনে; ওদিকে ক্রোয়াটরা জিতলে পয়েন্ট হবে নয়, আইসল্যান্ড থেকে যাবে একে। চার দলের মধ্যে সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যাবে ক্রোয়েশিয়া আর আর্জেন্টিনা। তবে মেসিদের পাশাপাশি আইসল্যান্ডও যদি জিতে যায়, সেক্ষেত্রে দু’দলের পয়েন্ট হবে চার। আর পয়েন্ট সমান হলে বিবেচনায় আসবে গোল ব্যবধান। এ পদ্ধতিতে আপাতত এগিয়ে আইসল্যান্ড। নরডিক দেশটির -২, আর্জেন্টিনার -৩। গ্রুপে অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পদ্ধতি অবশ্য আরও আছে। প্রথমটিতে ব্যবধান নির্ণয় করা না গেলে দ্বিতীয়টি, দ্বিতীয়টিতে না করা গেলে তৃতীয়টি… এভাবে আটটি। অষ্টম নম্বরটি হচ্ছে ড্র। তার আগের সপ্তমটি পর্যন্ত এগিয়ে আছে আইসল্যান্ডই। ফেয়ার প্লে পদ্ধতিতে আর্জেন্টিনা কার্ড হজম করেছে তিনটি; কিন্তু আইসল্যান্ড কোনো কার্ড দেখেনি। পেছনের এতসব হিসাবে যেন না যেতে হয়, সে জন্য কাজ একটিই- জিততেই হবে আর্জেন্টিনাকে। জয় বা ড্র করতে হবে ক্রোয়েশিয়াকেও। যেহেতু নিজেদের জয় পাওয়াটাই প্রথম এবং মূল মানদণ্ড, মেসিদের তাই ফোকাস রাখতে হচ্ছে নিজেদের খেলাতেই। যে আইসল্যান্ডের দেয়াল ভাঙতে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে প্রথম দিন, সে দলটিকেই ২-০-তে হারিয়েছে নাইজেরিয়া। তবে বিশ্বকাপের নাইজেরিয়া কখনোই আর্জেন্টিনার জন্য দুর্বোধ্য ছিল না। এর আগে মুখোমুখি দেখা হয়েছে চারবার। প্রতিবারই জিতেছে আর্জেন্টিনা। সর্বশেষ ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসির দুই আর মার্কো রোহোর এক গোলের সুবাদে নাইজেরিয়াকে ৩-২-এ হারিয়েছে আলবিসেলেস্তেরা। বিশ্ব ফুটবলের ঐতিহ্য আর বর্তমান র্যাংকিং অনুসারেও বেশ এগিয়ে আর্জেন্টিনা। কিন্তু আইসল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে মেসিদের দলের পারফরম্যান্স আর মনোবল যে পর্যায়ের দৃষ্টিকটু ছিল, সেটিই শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের। ইতিমধ্যে দলের মধ্যে বিদ্রোহের খবর চাউর হয়েছে একাধিকবার। যা খণ্ডন করতে শেষ পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনেও আসতে হয়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান ক্লদিও তাপিয়াকে। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, হোর্হে সাম্পাওলিকে আর কোচ হিসেবে মানতে চাইছেন না মেসি, মাশ্চেরানো, আগুয়েরোরা। নাইজেরিয়া ম্যাচের ফরমেশন নাকি তারা নিজেরাই সাজিয়েছেন। কোচের ওপর সন্তুষ্টির খবর সত্য-মিথ্যা যেমনই হোক, এটি সত্য যে, প্রথম দুই ম্যাচের প্রভাব পড়ছে আজকের খেলায়। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে বিপর্যয়ের শুরু যে গোলরক্ষকের ভুল দিয়ে, সেই উইলি ক্যাবায়েরোকে আজ একাদশে রাখা হচ্ছে না। সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রিভারপ্লেট গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানিকে। গত ম্যাচে বাদ পড়া অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া আর মার্কো রোহোও ফিরে পাচ্ছেন প্রথম একাদশের জায়গা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে স্ট্রাইকিংয়ে। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে গোল করা আগুয়েরোর জায়গায় নামানো হতে পারে গঞ্জালো হিগুয়েইনকে। তবে খেলোয়াড় পরিবর্তন যেমনই হোক, আর্জেন্টিনার আজ বড় বদল দরকার দলের শারীরিক ভাষা আর ম্যাচের ফলে। নইলে যে দ্বিতীয় রাউন্ডেই আর খেলা হবে না!
এবার কোন ফরমেশন
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে (৪-২-৩-১) ফরমেশনে দল সাজিয়ে তাও এক পয়েন্ট পায় হোর্হে সাম্পাওলি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি কি-না বেছে নেন (৩-৪-৩) ছকটা। কথায় আছে না, নতুন বোতলে পুরনো মদ! আর্জেন্টিনা কোচ মনে হচ্ছে সে কাজটাই করেছেন। চিলির কোচ থাকাকালে এ ফরম্যাটই ছিল সাম্পাওলির বেশ পছন্দের। ক্রোয়েটদের বিপক্ষে তিনি সেটাই ব্যবহার করলেন। তাতে যে পুরো দলই ডুবল। অবশ্য ৩-৪-৩ ফরমেশনে চিলি সাফল্য পায়নি এমন কিন্তু নয়। তবে চিলি আর আর্জেন্টিনা খেলোয়াড়দের ফিটনেস আকাশ-পাতাল তফাৎ। কারণ ৩-৪-৩ এই ছকে বসে থাকার সুযোগ কম ফুটবলারদের। সারাক্ষণ থাকতে হবে দৌড়ের ওপর। কিন্তু মেসিরা যে সেই তালে নেই। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ধীরে-সুস্থে খেলে থাকেন। ফলে সাম্পাওলির পরিকল্পনাও ফলল না। লুকা মডরিচ-ইভান রাকিটিচদের নিয়ে গড়া দারুণ মিডফিল্ডভিত্তিক ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মূল একাদশে আক্রমণভাগের মাঝে সার্জিও আগুয়েরোকে রেখে ডানে লিওনেল মেসিকে খেলান সাম্পাওলি। বাঁ পাশে রাখেন ম্যাক্সিমিলিয়ান মেজাকে। খেলা শুরুর পর দেখা যায়, মেজার দিক থেকেই সিংহভাগ আক্রমণ চালাচ্ছে আর্জেন্টিনা। দলে যে একজন মেসি আছেন তার কোনো খবর নেই। ঠিক এ জায়গায়ই দেখা গেল সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সে ম্যাচের পর সাম্পাওলির ফরমেশন নিয়ে অবাক হয়েছেন ফুটবলের রথী-মহারথীরা। প্রশ্ন তোলেন তার কৌশল নিয়ে। পরপর দুই ম্যাচে আলোর মুখ না দেখে সাম্পাওলিও বেশ চাপে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের পর রীতিমতো গুঞ্জন উঠেছিল তার বরখাস্ত হওয়া নিয়ে। যাক, এ যাত্রায় রক্ষা হলো তার। তবে বিশ্বকাপের পর তাকে হয়তো ছেঁটেই ফেলবে আর্জেন্টিনা; যদি কি-না ব্যর্থ হন। আজ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার বাঁচা-মরার লড়াই। যে করেই হোক এই ম্যাচে জিততে হবে আলবিসেলেস্তেদের। সেজন্য দলে ব্যাপক রদবদল হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সুপার ঈগলদের বিপক্ষে খুব সম্ভবত ৪-৩-৩ ফরমেশনটা ফলো করবে আর্জেন্টিনা। এমন কিছু হলে রক্ষণে তিনজনের বদলে চারজনকে দাঁড় করানো হবে। মিডফিল্ডে রাখা হতে পারে তিনজনকে- বানেগা, বিলগিয়া আর মাশ্চেরানো। আক্রমণভাগের ডানে মেসি আর বাঁয়ে ফিরিয়ে আনা হবে ডি মারিয়াকে। বরাবরের মতো সামনে থাকবেন আগুয়েরা। আর গোলপোস্টের নিচে দেখা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই ক্যাবায়েরোর। আসতে পারে নতুন মুখ ফ্রাঙ্কো আরমানি।