টি.আই সানি,গাজীপুরঃ
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় নামলেই যে কাউকে বেশ বিপাকে পড়তে হবে। নামমাত্র হাটার পথ আছে তবে সেটাতে হাটার অবস্থা নেই। পথচারীর চাইতে পণ্য ও পথব্যবসায়ীদের সংখ্যার আধিক্য চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর রাত বাড়ার সাথে সাথে চান্দনা চৌরাস্তা পরিনত হয় বাজারে, যা ছড়িয়ে পরে মূল সড়কে। ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে পরে এই এলাকা। এসময় ফুটপাথ দখলদারদের দৌরাতেœ্যর কারণে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই মূল সড়ক ধরে চলাচল করতে হয় পথচারীদের।
চান্দনা চৌরাস্তা সহ পশ্চিম দিকের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এগোতে পুরোটা ফুটপাতে চোখে পড়বে ফল, পোষাক আর বিভিন্ন প্রসাধনীর দোকান। আর উত্তর দিকে ময়মনসিংহ সড়কের উভয় পাশে ফুটপাতের দখল চোখে পড়ার মত। ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় যানজটের ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে পথচারীদের। বিশেষ করে বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর মহাসড়কের উপর ভ্রাম্যমান কাঁচাবাজারে সড়কের উভয় পাশের অর্ধেক দখল হয়ে যায়। গাজীপুরে মহাসড়কে দীর্ঘদিনের যানজটের অন্যতম কারন এই অবৈধ দখলযজ্ঞ।
সরেজমিন দেখা যায়,ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী বাজার, ষ্টেশন রোড, কলেজ গেইট, তারগাছ, বোর্ডবাজার, মালেকের বাড়ি, ভোগরা,চান্দনা চৌরাস্তা,বাঘের বাজার,গড়গড়িয়া মাষ্টারবাড়ি,মাওনা চৌরাস্তা,এমসি বাজার, নয়নপুর বাজার,জৈনাবাজার, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সিমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এলাকা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনবাড়ি ও চন্দ্রা পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকায় ফুটপাত দখল ছাড়িয়ে মহাসড়কে চলে এসেছে। এসব ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলের পেছনে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। স্থানীয় হাইওয়ে পুলিশেরও বানিজ্য রয়েছে তাতে। পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদে সিন্ডিকেটের পেছনে জড়িত রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। কয়েক ধাপে এসব ভ্রাম্যমান দোকান হতে টাকা উত্তোলণ করা হয়। কিছুদিন পরপর দোকান উচ্ছেদের নামেও হয় বানিজ্য।
সরেজমিন গাজীপুর শহরেও দেখা গিয়েছে ফুটপাত দখলের হিড়িক, গাজীপুর বাজারের কোন জায়গা এখন অবশিষ্ট নেই, সব সড়কে ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীদের আধিক্য। জেলার মুক্তমঞ্চটি এখন শুটকি ব্যবসায়ীদের দখলে। রেলওয়ের আশেপাশের দখলযজ্ঞও যে কারও চোখে ভেসে উঠবে। এ নিয়ে কথা হয়, বোর্ড বাজারে ফুটপাতের উপর থাকা কাপর ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের সাথে তিনি জানান, দৈনিক ভিক্তিতে নির্র্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অংক নির্ধারণ করে তাকে দোকানের জায়গা দিয়েছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী, তবে তাকে প্রতিদিনেই স্থানীয় পুলিশকেও টাকা দিতে হয়। টঙ্গীর কলেজ গেইট থেকে শুরু করে তুরাগ পর্যন্ত ফুটপাত ছাড়িয়ে মহাসড়কের অর্ধেক জায়গা অবৈধ দখলে চলে গেছে। কোথাও ভ্রাম্যমান হকার আবার কোথাও বা অবৈধ গাড়ির ষ্ট্যান্ড। এ জায়গায় প্রতিদিনই ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয় পথচারীদের। টঙ্গীর বাজার এলাকার ভ্রাম্যমান কাপর বিক্রেতা(ভ্যানগাড়ি) রফিকুল ইসলাম জানান,আমরা মূলত বিকেল হলেই মহাসড়কে আসি তবে পুলিশ এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রতিদিন দুইশত টাকা করে দিতে হয়। টাকা না দিলে আমাদের তাঁরা বসতে বাঁধা দেন।
বোর্ডবাজার এলাকায় ফুটপাতের দখল ছাড়িয়ে গেছে মহাসড়কের উপর, সন্ধ্যার পর কাঁচাবাজারের ভোগান্তি পোহাতে হয় পথচারীদের। বিভিন্ন মার্কেটের সামনে ফুটপাত দখল করে দোকানের পসরা সেজেছে।রাতে ফুটপাত ছেড়ে তা আছড়ে পরে মহাসড়কের উপর। হাইওয়ে পুলিশের সামনে এসব দোকান বসিয়ে প্রতিদিন টাকা উঠাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মার্কেটের মালিক। স্থানীয় পুলিশের সহযোগীতায় কোন কোন ক্ষেত্রে মার্কেটের মালিককেও ফুটপাতে দোকান বসাতে জামানত প্রদান করতে হয়। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা হতে বোর্ড বাজার পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে রয়েছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব এলাকার ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় কারখানা ছুটির পর হাজার হাজার শ্রমিককে মহসড়ক ধরে হেটে চলতে হয়। এতে চরম নিরাপত্তার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। মেট্রিক্স সোয়েটার কারখানা শ্রমিক রাফেজা আক্তার জানান,কারখানা ছুটির পর বাসায় ফিরতে ফুটপাত ধরে চলাচল করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় মহাসড়ক ধরে চলতে হয়। এতে জীবনের নিরাপত্তার হুমকী থেকে যাচ্ছে।
প্রভাতি বনশ্রী পরিবহনের চালক মোজাম্মেল হকের মতে,গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা হতে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত মহাসড়কের উভয় পাশে ফুটপাতগুলো দখল ছাড়িয়ে মহাসড়ক পর্যন্ত চলে এসেছে। সড়কের জায়গা দখলমুক্ত না হওয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট যেন এখন আমাদের এক প্রকার নিয়তি। গাজীপুরের ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন,আমরা প্রশাসনের কাছ হতে বছর খানেক আগে গাজীপুরকে গ্রীন ও ক্লিন সিটি গড়ার আশ্বাস পেয়েছিলাম, কিন্তু বাস্তবে তা ঘোষনাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। নানা সমস্যায় আবর্তিত গাজীপুরে এখন বসবাস করাই দায় হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে গাজীপুর ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, মহাসড়কের উপর যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা যানজট সৃষ্টির মূল কারন। আর রাজধানীর প্রবেশ মুখে চান্দনা থেকে শুরু করে টঙ্গী পর্যন্ত বিভিন্ন সড়কের উপর ভ্রাম্যমান দোকান থাকায় প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হয়। ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলে থাকায় সাধারণ লোকজন তা ব্যবহার করতে পারে না, বাধ্য হয়ে তারা মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে।
গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার বদরুল আলম এসব ভ্রাম্যমান দোকান বসানোর পেছনে পুলিশের সহযোগিতার কথা অস্বীকার করে জানান,মহাসড়কের নিরাপত্তা দিতে সার্বক্ষনিক হাইওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশের চোখের আড়ালে কেউ মহাসড়কে ভ্রাম্যমান দোকান বসালে আমরা উচ্ছেদ করে থাকি। ইতিপূর্বে ভ্রাম্যমান দোকানপাট উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে যা অব্যাহত আছে।সার্বিক বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড: দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান,জনগনের ভোগান্তি কমিয়ে ফুটপাত অবৈধ দখল মুক্ত করতে ইতিপূর্বে একাধিক বার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গ্রীণ এবং ক্লিন সিটি উপহার দিতে প্রয়োজনে আবারো অভিযান পরিচালণা করা হবে।