কাউন্সিলের প্রায় আড়াই মাস পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করতে না পারা, বিভিন্ন সভায় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসামঞ্জস্য বক্তব্য ও দলীয় কোন্দল- ত্রিমুখী সংকটে পড়েছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি।
দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিএনপি-কে নেতৃত্ব সংকটে ফেলতে প্রথম থেকেই সরকারের একটি বিশেষ বাহিনী তৎপর। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। বর্তমানে তার একাধিক মামলা নিস্পত্তির দিকে এগুচ্ছে সরকার। সরকারের মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে নির্মূল করে একদলীয় শাসন কায়েম করা।
এই মুহূর্তে আন্দোলন নয়, রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন দলকে গোছানো। এ জন্য দরকার দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা। না হলে পরবর্তীতে রাজনৈতিক মাঠে বিএনপির জন্য ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই অতীত কর্মকাণ্ডের আলোকে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব ঠিক করতে হবে। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে বলে তারা মনে করেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এটা সত্য বিএনপি বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে এক প্রকার অগ্নিপরীক্ষা বা তার চেয়েও বেশি কিছু। তবে আমরা প্রথম থেকেই বলে যাচ্ছি, সরকার যে উদ্দেশে বিএনপিকে দেশ থেকে নির্মূল করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে তা সফল হবে না। বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়াবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে বিএনপির মূল চ্যালেঞ্জ আমাদের নেত্রীর (খালেদা জিয়া) নামে চলমান মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্রুত কমিটি ঘোষণা করা। যেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে, যারা সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এর মাধ্যমে বিএনপির আগামী দিনের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আসবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৩টি মামলা রয়েছে। কোনো মামলার বিচার শুরু হয়েছে, আবার কোনোটি তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ৫টি, মানহানির অভিযোগে ৩টি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে একটি ও নাশকতার অভিযোগে ৪টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ এক মতবিনিময় সভায় সরকারকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কী ভূমিকা ছিল? সেটাও তো নয়। তারা আবার রাজাকার বলে? মুক্তিযুদ্ধের সময় তো তারা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সাহস পাই নাই। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে জিয়াউর রহমান। যুদ্ধ না করলে যোদ্ধা হয় নাকি? ফলে মুক্তিযোদ্ধা তারা নয়, মুক্তিযোদ্ধার দল হলো বিএনপি।
খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যর পরিপ্রেক্ষিতে ফের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় দলটিকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন দলীয় প্রধানের কাছ থেকে এমন বক্তব্য কেউ প্রত্যাশা করে না। খালেদা জিয়ার এমন অসামঞ্জস্য বক্তব্যই প্রমাণ করে তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘যখন একটি রাজনৈতিক দলের কোনো কর্মসূচি বা কোনো ইস্যু থাকে না তখন তারা উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক মাঠ গরম রাখার চেষ্টা করে। বিএনপি এখন সেই পথ অনুসরণ করছে বলে আমি মনে করি। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যগুলো তাই প্রমাণ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অতিথেও দেখেছি, বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিদেশ থেকে বিভিন্ন সময় দেশের রাজনীতি ইতিহাস নিয়ে বিকৃত করে মন্তব্য দিয়েছেন। এগুলো মূলত রাজনীতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপি যে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে তাই প্রমাণ করে।’
সূত্র মতে, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য লিখে দেন মূলত তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা বা বিশেষজ্ঞরা। খালেদা জিয়ার বক্তব্য লিখে দেওয়ার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সম্প্রতি গ্রেফতার সাংবাদিক শফিক রেহমান। তার গ্রেফতারের ফলে কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে দলটি। সূত্র মতে সর্বশেষ, বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের বক্তব্য লিখে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শফিক রেহমান।
অন্যদিকে দীর্ঘ আড়াই মাস অতিবাহিত হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে না পারায় তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে দলটির তীর্ণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সকল নেতাকর্মীদের মাঝে। তাদের প্রশ্ন, আসলেই কী বিএনপি নেতৃত্ব পাচ্ছে না? নাকি এটা তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তবে তাদের কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়া আর ভুল করতে চায় না বলেই কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে একটু সময় নিচ্ছেন। শিগগিরই বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সেই শিগগিরই কবে শেষ হবে তার সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম বলেন, ‘সরকার দেশের বিরোধী দলের নামে একের পর এক মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে এ বিষয়টিকে শেষ পর্যায়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা যা বলে তাই সঠিক, এখানে জনমতের কোনো প্রাধান্য নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে চলমান মামলা গুলোও এখন প্রায় শেষ পর্যায়ের দিকে। তবে আমরা বলতে চাই এর পরিণতি সরকারের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। আমরা তীর্ণমূল বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছি। আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত আছি।’
পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রসঙ্গে বিএনপি এ নেতা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি এটা তো এক ধরনের হতাশা আছেই। তাই আমরা তীর্ণমূল মনে করি এ বিষয়টির সুরুহা দ্রুত হওয়া উচিত। হয়তোবা সরকারের একের পর এক মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদির জন্য হচ্ছে না। তবে শিগগিরিই কমিটি ঘোষণা হবে। কারন যত দ্রুত কমিটি ঘোষণা হবে ততই মঙ্গল।’
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ছয় বছর পর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দলটির বহুল প্রত্যাশিত ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কাউন্সিলের প্রায় আড়াই মাস অতিবাহিত হতে চললেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি খালেদা জিয়া। সম্মেলনের আগেই দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন খালেদা। এর পর তিন দফায় ৪২ নেতার নাম ঘোষণা করেছে দলটি।