মোঃ অালী হাসান: পাঁচবিবি(জয়পুরহাট) প্রতিনিধিঃ “ও বউ ধান ভাঙ্গেরে ঢেঁকিতে পা দিয়া ঢেঁকি নাচে, বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানোরে ’’এ ধরনের অনেক গান ও কবিতা রয়েছে ঢেঁকি নিয়ে। সময়ের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিকায়নের
ধারায় প্রতিনিয়ত মানুষের গতির পরিবর্তন হচ্ছে। সারা বাংলায় একটা সময় ছিল বাংলার একমাত্র যন্ত্রই ধান ভানার ঢেঁকি। গ্রামের কৃষাণী থেকে শুরু করে জমিদারবাড়ি পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল এ ঢেঁকির প্রচলন। প্রাচীন কাল থেকে এই উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে
আসছে। তখন বাংলার ঘরে ঘরে চিড়া কোটা, চাল ও চালের গুড়া করার জন্য ঢেঁকিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের
সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিল। কম সময়ে বেশি কাজ করার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধান ভানার কাঠের ঢেঁকিও। “ও বউ ধান ভাঙ্গেরে ঢেঁকিতে পা দিয়া ঢেঁকি নাচে বউ
নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানোরে ’’ জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া এ গানটি এখনও মঞ্চে, মাঠে-ময়দানে মাঝে মধ্যে শোনা যায়। শুধু শোনা যায় না ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ। গ্রাম বাংলার চিরায়িত সেই ঢেঁকি আর ঢেঁকির তালে সেই গান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কালের বিবর্তণে আর যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে গ্রাম বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে। বাঙালি জীবনাচারণের আরেকটি বড় অংশ ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামে এক সময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হতো। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত না আমোদ-আহ্লাদে নাচতো আর গাইতো। বাঙালি জীবনের
এই উৎসবটার সাথেও ছিল ঢেঁকির সম্পর্ক। ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের আটা হতে তৈরি হত নানা উপাদেয় বাহারী সাজের রকমারি পিঠা। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম
পড়ে যেত। প্রবাদে আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। যদিও এক সময় শ্রীপুরের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কাঠের ঢেঁকি দেখা যেতো। গ্রামগুলোতে
নিয়মিত শোনা যেতো ঢেঁকির ঢাঁক ঢুক শব্দ। বর্তমানে চোখে পড়ে না বিয়ে শাদি ও আনন্দ উৎসবে ঢেঁকিতে ছাটা চালের তৈরী ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা তৈরীর দৃশ্য। সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আবার.গতিময় সভ্যতার যাত্রা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষই ঢেঁকি বিলুপ্তি করে দিয়েছে। একে না মেনে উপায় নেই। এক
দশক আগেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি চোখে পড়ত। গ্রামের মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কত ভোরে উঠে ঢেঁকিতে পা দিতে পারবে এবং কে কত বেশি ধান ছাঁটাই করতে পারে। কৃষক বধূর ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতো । ধান ভানার সময় মহিলাদের হাতের চুরির ঝনঝন শব্দ হত। শব্দ হতো পায়ের নুপুরের সব মিলিয়ে সৃষ্টি হতো এক সঙ্গীত মুখোর পরিবেশ।
ঢেঁকি কাঠের তৈরি। কুল, বাবলা, জান, গাব ইত্যাদি কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা হতো। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য এবং পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু এর মাথায় এক হাত লম্বা একটি কাঠের তক্তা থাকে। একে বলে রেনু বা ছিয়া। এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গোলা। গোলার মুখ যে স্থানটি মাটি স্পর্শ করে তাকে বলে গড়। এটা চার পাঁচ ইঞ্চি গর্ত। গর্তের ভিতরে স্থাপিতহয় কাঠের একটি অংশ। অনেকে কাঠের পরির্বতে পাথর খন্ড ব্যবহার করেন। তবে যাই ব্যবহার করা হোক না কেন সেটি হয় খুব মসৃন এই গতের্র ভেতর দেয়া হয় ধান। ঢেঁকির পেছনে ঢেঁকিতে
ধান ভানতে সাধারণ দু’তিন জন লোকের প্রয়োজন। একজন ঢেঁকিতে ধান দেয় গাড়ের (গর্তের) ভিতর ধান নাড়াচাড়া করে। একজন বা দু`জন পাড় দেয়। অনেক সময় বেশি ধান হচ্ছে তা দু’তিন জনের দ্বারা হয়ে উঠে না, তখন চার পাঁচ জন লাগে। দু’তিন জন একসাথে পাড় দেয়। একজনে ধান উল্টা পাল্টা করে দেয়। এভাবে কয়েকবার ধান পাড় দিয়ে
খোসা আলাদা করার পর কুলো দিয়ে ধান পরিস্কার করতে হয়। তখন বের হয় চাল। এতে যথেষ্ট পরিশ্রমও বটে। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে ঢেঁকি হয়তো অপরিচিত।
ঢেঁকির নাম শুনেছেন অনেকেই কিন্তু চোখে দেখেননি। এমন লোকও আছে। আমাদের গানেও প্রবাদে অনেকবার ঢেঁকির কথা এসেছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত গান রচনা করেছেন। পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকির প্রাণ। পাঁচবিবি উপজেলা কুসুম্বা ইউনিয়নের বাঁশখুর গ্রামের লবিজা(৩৫) ও তার মা অাজু(৭০)বলেন, “ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গনের কাজে অামাদের সাথে ৩/৫জনক বেগার দেওয়া লাগতো। তার পরেও অামাদের কাছে একাজ অনেক ভালা লাগতো। উপজেলার অাওলাই ইউনিয়নের পানিয়াল গ্রামের ফারজানা(৫০) বলেন, “ঢেঁকি চাটা চাল খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। আমি বাচ্চাদের জন্য ঘরের খাবার পিঠা তৈরি করতে ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করি। ঢেঁকি চাটা চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পিঠা অনেক সুস্বাদু হয়। যদিও এখন আর আগের মতো প্রতি বাড়িতে কাঠের ঢেঁকি
পাওয়া যায় না, যার কারনে একটু কষ্ট করে হলেও একপাড়া থেকে অারেক পাড়ায় যেতে হয়। নিজেদের ইচ্ছে মত প্রয়োজনের সময় আমাদের ঢেঁকিতে চাল ও পিঠার গুঁড়ো ভানতে হয়”। স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা, গ্রামীণ মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, আন্তঃনির্ভরশীলতা, সুখ-দুঃখের কথা সহভাগিতায় ঢেঁকির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই আমাদের গ্রামীণসমাজে ধান ও পিঠার গুঁড়ি ভানায় প্রয়োজন মেশিন নির্ভরশীলতা হ্রাস করে গ্রামীণ প্রযুক্তি ঢেঁকির প্রচলন করা এবং বিলুপ্তির হাত থেকে ঢেঁকিকে রক্ষা করা