পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি ঃ কাজে নারীদের ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কম। তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীশ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু তারপরও মজুরি-বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীশ্রমিকরা। নারীশ্রমিকরা এখনো পুরুষ-শ্রমিকের সমান কাজ করেও কম মজুরি পাচ্ছেন। বাঁচতে হলে কাজ করতে হবে এমন প্রতিজ্ঞা করেই যেন বৈষম্যময় পরিবেশে কাজে নেমেছেন ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নারীশ্রমিকরা। কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য মেনে নিয়েই পুরুষের সঙ্গে লড়াই করে কাজ করে চলছেন তারা। কখনও সমান কিংবা কখনো বেশি কাজ করছেন। তবু কম মজুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আবার এই নারীদেরই জীবিকার জন্য মাঠে-ঘটে কাজ করলেই শুধু চলে না। বাইরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঘরে ফিরে সংসারও সামাল দিতে হয় তাদের। যেন কোনো মানুষ নন তারা, যেন তারা দম-দেওয়া মেশিন। ক্রমাগত কর্মের প্রহারে পাংশু তাদের জীবন। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ,রাণীশংকৈল,বালিয়াডাঙ্গী এলাকার কয়েকটি সড়কের সংস্কার কাজ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। যেখানে হাতে গোনা ২/১ জন পুরুষের বিপরীতে ৭/৮ জন পুরুষের বিপরীতে ৭/৮ জন নারীশ্রমিক কাজ করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ শ্রমিকরা সাজিয়ে ইটের ভাঙা অংশ বা খোয়া তুলে দিচ্ছেন। আর নারীরা তা মাথায় নিয়ে সড়কের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ফেলছেন। একটানা বিরামহীন। তবু এই কঠিন কাজটুকুও বেশ হাসিমুখেই করছেন তারা। এদের কারো বা স্বামী অসুখে অচল। তাই পরিবারের হাল ধরতে এই নারীরা সংসারের দুর্বহ বোঝা তুলে নিয়েছেন নিজেদের অশক্ত কাঁধে। বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ। এদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী জরিনা (৪৫)। তিনি জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। তাই কোন না কোনভাবে প্রতিনিয়ত কাজ খুঁজে বেড়াতে হয় তাকে। আজ ভাঙা ইট টানছেন তো কাজ মাটি টানবেন। নয়তো অন্য কোন কাজ। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জীবনের ঘানি টেনে চলেছেন তিনি। শুরুতে ৬০ টাকা মজুরি জুটতো। আর এখন পাচ্ছেন ৩৫০ টাকা। আর যেসময় কাজ থাকে না তখন শাক-পাতা বেচে কোনমতো দিন গুজরান করেন। কোনো ভাবেই বসে থাকার সুযোগ নেই। রাজিয়া বেগম ও কমলা নামের অপর ২ নারীশ্রমিক জানান, অভাব-অনটন ঘোচাতেই দিনমজুরের কাজে নামা। কিন্তু সেই ৭/৮ বছর আগে থেকেই দেখছেন সমান বা বেশি কাজ করেও পুরুষের থেকে তাদের মঞ্জুরি কম। আজ তারা যে কাজ করছেন এ কাজে একজন পুরুষ পায় ৪৫০ টাকা, আর নারী হয়ে একই কাজ করে পাচ্ছেন ৩৫০ টাকা। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে শ্রমের কষ্ট কিন্তু কারো থেকে কারো কম হয় না। তারপরও বৈষম্যের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। এদের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা চৈতী রাণী রায় বলেন, ‘হামার ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই জ্বালা কাক কি কহুমো। আমি ভালা না এই কথা কহেহেনে স্বামী চলে গেল। বেশি কাম করেহেনেও মাহাজনের মোন (মন) পাইনি হামা। সেই বেহানে (সাতসকালে) ৭টায় আইছি; যামো আবার সইন্ধ্যা (সন্ধ্যা) ৭টায়। তার পরো (তার পরও) মরদদের চাইয়া টাকা হামা কম পাই। আবার ঘরে গিয়া রান্দোন-বাড়োন না করলে প্যাটত কি দিম!’ তিনি বলেন, ‘গরিব মানুষদের সরকার কতো কিছু দে শুনিলু, কিন্তুহামরা তো কিছুই পাই না। এলা যা আয় করি খাওয়া ঘরভাড়া কিছুই টিকে না।’ এদিকে গ্রামের নারীশ্রমিকরা জানান, পুরুষের চেয়ে মজুরি কম পান তারাও। পাশাপাশি পুরুষদের সাথে সমান তালে কাজ করলেও কখনও কখনও পুরুষ সহকর্মী কিংবা ঠিকাদারের হাতে নিগৃহীতও হতে হয় তাদের। পীরগঞ্জ উপজেলার জয়কৃষ্টপুর গ্রামের কৃষক সুলতান হাওলাদার জানান, তাদের গ্রামে এখনও নারী ও পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য অনেক। যেখানে একবেলা ভাত খাইয়ে নারী শ্রমিককে দেয়া হয় ২ থেকে আড়াইশ টাকা, সেখানে পুরুষ-শ্রমিককে দেয়া হয় সাড়ে ৪ শ থেকে ৫ শ টাকা। আর নারীদের আর্থিক চাহিদা তেমন না থাকায় ২ শ টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকেন তারা। তাই তাদের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। এ বিষয়ে পীরগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র মানবাধিকার কর্মী নারীনেত্রী নাহিদ পারভিন রিপা বলেন, মে দিবসের ইতিহাস শত বছরের বেশি সময়ের পুরনো। শ্রমিকদের নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ সত্য। এর মধ্যে নারীশ্রমিকদের বিষয়টি আরো বেশি পরিলক্ষিত হয়। সিটি কর্পোরেশনের মতো জায়গায় বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতা শাখায় বেতন বৈষম্য রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কন্ট্যান্ট বেইজড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কন্ট্যাক্ট বেইজড শ্রমিকদের মধ্যে নারীদের কম বেতন দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। এই শ্রমিকদের পক্ষে আমাদের সরকারের মনোযাগ কখনোই দেখা যায় না। আমরা মনে করি, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই সমসার সমাধান করতে হবে।’