আব্দুর রহিম, মৌলবিবাজার থেকে।
চায়ের দেশ নামে খ্যাত
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলেও চায়ের বাজার চড়া হয়ে উঠেছে। শীত ও নির্বাচনকে
ঘিরে গরম চায়ের কাপের সাথে অস্থির হয়ে উঠেছে চায়ের বাজার। ধাপে ধাপে
মূল্য বৃদ্ধিতে ক্রয় ক্ষমতা সাধারন মানুষের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
প্রতি বছর সেপ্টম্বর-অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চায়ের চাহিদা থাকে
বেশ বাড়তির দিকে। এ বছর আসন্ন নির্বাচনের কারণে তার মাত্রা আরো বেশি।
প্রয়োজনের তুলনায় ঘাটতি রয়েছে পণ্যটির উৎপাদন ও সরবরাহের। গত এক মাসে
পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০০ টাকারও বেশি। এখন নির্বাচন
ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যটির আরেক দফা দাম বাড়ার আশংকায় আতংকে আছেন
গ্রহকরা। বাজার আরো চড়া হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
নির্বাচন মৌসুমে দেশের চায়ের দোকান গুলোতে থাকে জমজমাট আড্ডা। এমনিতেই চা
বিক্রি বেড়ে যায় অনেক। এ সময় চায়ের দোকানে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে
রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণারও হয়ে
ওঠে জমজমাট চা। বিষয়টি নিয়ে আসন্ন নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৩ সংসদীয় আসন থেকে
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী উত্তর জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় চা এক
অনন্য অনুষঙ্গ। ভোটারের মনোযোগ আকর্ষণ, প্রচারণা, নির্বাচনী আড্ডা ও
সাংগঠনিক কার্যক্রমে চায়ের সংস্কৃতি অনেক পুরনো। এর সঙ্গে শীতের আমেজ
যুক্ত করলে এবারের নির্বাচনে চায়ের চাহিদা বেশি থাকবে। তবে শহরের তুলনায়
গ্রামঞ্চলেই নির্বাচনী চায়ের চাহিদা থাকবে বেশি।
শ্রীমঙ্গলের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে
দেশে শীত মৌসুম জুড়েই নির্বাচনী কার্যক্রম চলবে। শীতের বাড়তি প্রকোপের
পাশাপাশি রাজনৈতিক উত্তাপের কারনে এ সময় দেশের গ্রামাঞ্চলেই চায়ের চাহিদা
থাকবে সবচেয়ে বেশি। এ কারনে এখন থেকেই পাইকারি বাজারে খোলা চায়ের চাহিদা
বেড়ে গেছে। দেশে চায়ের বাজারে অস্থিরতা চলছে কয়েক মাস ধরেই। প্রতি বছর
পণ্যটির চাহিদায় ৪-৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা দিলেও সে তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে
ধীর গতিতে। এছাড়া দেশী বাগান মালিকদের সুরক্ষা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত
শুল্কারোপ করা হয়েছে চা আমদানিতে। ফলে প্রাথমিকভাবে আমদানি কমলেও আসন্ন
শীত ও নির্বাচনকালীন চাহিদাকে কেন্দ্র করে পণ্যটির বিপণনকারী বড়
প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাড়তি খরচেই বিশ্ববাজার থেকে চা সংগ্রহ করছে। ফলে
দেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহের
শুরুতেও খুচরা বাজারে চায়ের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত
আন্তর্জাতিক নিলামে চায়ের দাম ছিল বেশ কম। কিন্ত এবারের বর্ষা মৌসুমে
দেশের চা বাগান গুলোয় পণ্যটির উৎপাদন খুব একটা আশানুরূপ ছিল না। ফলে
সরবরাহ কমে গিয়ে ভরা মৌসুম শুরুর আগেই দাম বাড়তে থাকে পণ্যটির। সর্বশেষ
২৬তম নিলামে চায়ের গড় দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এতে ১৭ শতাংশ
শুল্ক পরিশোধের পর গুদাম থেকে চা সংগ্রহ করে মোড়কজাত ও বাজারজাত করতেই
কেজি প্রতি মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪০০ টাকা। কখনো কখনো তা আরো বেশি।
ফলে বাজারে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪০০-৫৫০ টাকায়। যদিও কয়েক মাস
আগেও খুচরা ও মোড়কজাত চায়ের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৫০-৪০০ টাকার মধ্যে।
শীতকাল ও নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে মজুদ বাড়াতে শুরু করেছে মোড়ক
জাতকারী কোম্পানি গুলো। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, দেশের আনাচে-কানাচে
চায়ের চাহিদাও তত বেড়ে যাবে। ফলে বাড়তি চাহিদা সামাল দেয়ার পাশাপাশি
অতিরিক্ত মুনাফার আশায় পাইকারি ও মোড়ক জাতকারী ব্যবসায়ীরা মজুদ বাড়িয়ে
দিয়েছেন। কিন্ত নিলামে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চা না পাওয়া গেলে বিকল্প
উপায়েও পণ্যটি সংগ্রহের কথা ভাবছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে বড়
প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসা চোরাই চা
সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার রাখার শর্তে
চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় ব্র্যান্ডের চা মোড়ক জাতকারী প্রতিষ্ঠানের
স্বত্বাধিকারী জানান, কয়েক মাস ধরে চায়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপণন কমিয়ে
দেয়া হয়েছে। শীতে চাহিদা বৃদ্ধি ছাড়াও নির্বাচনে বাড়তি চাহিদার সম্ভাবনায়
অনেকেই এখন কম দামে চোরাই পণ্য সংগ্রহ করছে। আমার প্রতিষ্ঠানও কুমিললাসহ
বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে আসা চা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এসব
চা সংগ্রহ হলে বাড়তি চাহিদার কারনে কিছুটা লাভ হবে।
এ সময় শুল্কহার ও নিলামে দাম বেশি থাকায় চা সংগ্রহ ও মোড়ক জাতের
ব্যবসায়ীদের মুনাফার হার অনেক কমে গেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। প্রসঙ্গত,
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে চা আমদানি হয়েছে ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩০
কেজি। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই আমদানি হয়েছে ২৫ লাখ ১৭ হাজার কেজি।
অতিরিক্ত শুল্কারোপের ফলে চায়ের আমদানি মূল্য বেড়ে গেলেও আসন্ন
নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই পণ্যটির আমদানি বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ২৬তম আন্তর্জাতিক নিলামে
বিক্রির জন্য চা তোলা হয়েছিল ২৫ লাখ ৬১ হাজার ৫৩৮ কেজি, যা আগের বছরের
একই নিলামের তুলনায় ২১ হাজার ২৯৪ কেজি কম। নিলামে প্রস্তাবিত চায়ের ৯৫
শতাংশই কিনে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এক মাস আগেও নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড়
দাম ছিল ২৭০-২৮০ টাকার মধ্যে। সেখানে সর্বশেষ নিলামে তা বিক্রি হয়েছে গড়ে
৩০০ টাকার বেশি দামে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় আগামী নিলাম
গুলোতেও পণ্যটির দাম বাড়তির দিকে থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন চা ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে এইচআরসি গ্রুপের চা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. ইদ্রিস
বলেন, সামনে শীতকাল ও নির্বাচন থাকায় চায়ের চাহিদা বাড়বে। আগের বছরের একই
সময়ের তুলনায় চায়ের উৎপাদন প্রায় সমান হলেও অজানা কারণে নিলামে চায়ের দাম
কমছে না। সরকারও চা আমদানিতে শুল্ক না কমানোয় বাজার দর অস্বাভাবিক
বেড়েছে। তবে নির্বাচনী চায়ের বাজারে বাড়তি সরবরাহ না থাকলে চায়ের দাম
খুচরা পর্যায়ে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ
অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল হোসেন বলেন, একসময় নির্বাচন
এলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগাম চা সংগ্রহ করতেন ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে দেশে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির হাতে চায়ের খুচরা বাজার চলে যাওয়ায়
বড় বড় কোম্পানি নিলাম থেকেই চা সংগ্রহ বাড়িয়েছে। নির্বাচনে গ্রামগঞ্জে
চায়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় এবারো মজুদ শুরু হয়ে গেছে। এতে দাম
বাড়তে থাকায় খুচরা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে।
খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে প্রতি কেজি শওয়ালেস ক্লোন চা
বিক্রি হতো ৫০০ গ্রাম ১৭৫ টাকায়। কিন্ত দুই মাসের ব্যবধানে এর দাম বেড়ে
দাঁড়িয়েছে ২৭৫ টাকায়। আবুল খায়ের গ্রুপের সিলন ব্র্যান্ডের চা প্রতি ৫০০
গ্রাম আগে ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮০ টাকায়।
গত সাপ্তাহে দেশের শীর্ষ চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো চায়ের দাম কেজি
প্রতি আরো ৩০ টাকা করে বাড়িয়েছে।