বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি করার এখনই উপযুক্ত সময়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে রাজি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন তাতে রাজি ছিলেন না। তবে দ্বিতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আশা দেখছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমরা ইতিবাচক হতেই পারি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যাদিকে মমতা বাংলাদেশে এসে বলে গিয়েছেন আমার ওপর আস্থা রাখুন।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে যে চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত ছিল, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসেন। চার বছর পর ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উপলক্ষে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে এসে তিস্তা নিয়ে তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে বলে গিয়েছিলেন। তিস্তা নিয়েও কোনো সমস্যা হবে না, আমার ওপর আস্থা রাখুন। এমনটাই বলেন মমতা।
২৭ মে দ্বিতীয়বার শপথ অনুষ্ঠানে কলকাতায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে মমতা বলেন, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াই ও ভারত উপমহাদেশে শান্তি রক্ষায় অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিতে চাই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যদি প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা নিতে কলকাতা যান তবে তিস্তার সমাধানই হবে এ সফরের মূল বিষয়। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান। কোন প্রকার কালক্ষেপণ না করে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে বলা উচিৎ। চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
ভারতকে আর একটি বিষয়ে স্বরণ করিয়ে দেওয়া উচিৎ যে ১৯৯৬ সালে পদ্মা নদীর পানিবণ্টন যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে লেখা ছিল শুধু গঙ্গা নয় কোন নদীর পানি প্রত্যাহার বা অববাহিকায় কোনো কিছু করা যাবে না যেটা প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়। যে কোনো সরকার যখন একটা দলিলে সাক্ষর করে তা বাস্তবায়ন করা পরবর্তী সরকারগুলোর দায়িত্ব, যতই তাদের রাজনৈতিক মতভেদ থাকুক।
তিস্তার পানি নিয়ে কথা চালিয়ে যেতে হবে। আর এটা রাজনীতিকদেরই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা চুক্তি হতে পারে, তিস্তা চুক্তিও হবে বলে আশা করি। বাংলাদেশে স্থীতিশীল, স্বাভাবিক ও সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্ব চাই। এটি আমাদের বাঁচা-মরার সমস্যা তা বুঝানো খুব একটা কঠিন নয়।
ভারতের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে যে একটি তীব্র মাথাব্যাথা ও উদ্বেগ ছিল তা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই দৃঢ় হস্তে, কঠিন সিদ্ধান্ত ও ঝুঁকি নিয়ে তা সমাধান করেছেন। এ জন্যই ভারতের পক্ষ থেকে মনোভাব ইতিবাচক থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাদ বলেন, তিস্তা নদীর পানি নিয়ে আসার কাজ রাজনীতিকের। তিস্তার পানির অধিকার অর্জনে জনমত রয়েছে। রাজনীতিকদের কাজ হলো এ অধিকার অর্জন করে নিয়ে আসা। তবে রাজনীতিবিদরা কীভাবে এগুবে তা বলা দুষ্কর।
তিনি বলেন, তিস্তা নদী যদি পানিশূন্য হয়ে যায় তাহলে তার ইকো-সিস্টেম নষ্ট হয়ে গিয়ে তা ধীরে ধীরে মরে যাবে। এ নদীটিও মরে যাচ্ছে। নদীকে কোরামিন দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রচুর বিনিয়োগের পরেও পানি না আসলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ কাজ করবে কী-না বুঝা যাচ্ছেনা। এটার কোন সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানির একটা ভাগ রয়েছে। সকল নদীর মত তিস্তাকেও অববাহিক দিক থেকে পরিকল্পনা করে ব্যবহার করতে হবে। উজানের দেশ ও ভাটির দেশ মিলে এ পরিকল্পনা করবে।
তিনি বলেন, গত বছর জাতিসংঘ প্রণীত ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর অন্যতম হলো পানির অধিকার নিয়ে ৬ নং অনুচ্ছেদটি। ৬নং অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের জন্য জাতীসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ১২টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছেন। এই কমিটির অন্যতম সদস্য শেখ হাসিনা। এখন বাংলাদেশের জন্য সুযোগ রয়েছে পানির অধিকার নিয়ে কৌশল প্রণয়ন করার। ২০১৮ সালে এ কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, তিস্তাসহ অন্য সকল নদীর পানি ভারত এককভাবে সরাতে পারে না কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়া। ভারত বাংলদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপে বেশি খুশি তার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদেরকে খুব শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। পানি নিয়ে ভারত নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তা বর্তমান দুনিয়ায় সম্ভব নয়। পানি ইস্যুটি আমাদের মানবাধিকার। ভারতে খরা চলছে তাদের ক্ষেত্রেও যেমন এটা মানবাধিকার তেমনি বাংলাদেশের জন্যও। গঙ্গা পানি চুক্তি যেভাবে হয়েছে, সেভাবে অন্য নদীগুলোতেও তা হতে হবে।
তিনি বলেন, এ পদক্ষেপগুলো রাজনীতিকদের নিতে হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া তাতে লেগে থাকতে হবে। এ ইস্যুতে আমরা জাতিসংঘেও যেতে পারি। তবে সেখানে গিয়ে বিশেষ কিছু কাজ হবে না। যা করতে হবে দুই দেশ মিলেই করতে হবে।