যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে দাপটের সঙ্গে ঠিকাদারি করে আসা এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমের সম্পদের তথ্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দিয়েছে ব্যাংকসহ ১২টি সংস্থা। এসব সংস্থার কাছ থেকে তাঁর সম্পদের তথ্যসংবলিত দুই হাজার নথি গতকাল মঙ্গলবার সিআইডি পেয়েছে। তদন্তকারীদের ধারণা, তাঁদের হাতে আসা এসব নথিতে জি কে শামীমের হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য রয়েছে। তাঁরা ওই সব নথি দেখে সম্পদের তালিকা করার কাজ শুরু করেছেন। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের দেশেই শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর দুটি বাড়ি থাকার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে সিআইডি সূত্র।
জি কে শামীমের সম্পদের পাহাড় : অবৈধ ক্যাসিনো কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর জি কে শামীমের নাম আলোচনায় আসে। তাঁকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় কালের কণ্ঠে। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতন থেকে জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই দিনই একই এলাকায় তাঁর ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্স অ্যান্ড কম্পানি লিমিটেডের কার্যালয়ে র্যাব অভিযান চালায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার কাগজপত্র। এর মধ্যে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর শামীমের মায়ের নামে, বাকিটা তাঁর নিজের নামে করা। এ ছাড়া নগদ এক কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ৯ হাজার মার্কিন ডলার ও ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র ও মদও জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর সাত দেহরক্ষীকে। শামীমের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, অস্ত্র ও মাদক আইনে তিনটি মামলা হয়েছে গুলশান থানায়। মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচারের মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। এর মধ্যে তাঁকে চার দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ (রিমান্ড) করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন জি কে শামীম।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তাঁর সম্পদের তালিকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ ১২টি সংস্থার কাছ থেকে দুই হাজার নথি পেয়েছে সিআইডি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কয়েকটি সংস্থার কাছে জি কে শামীমের সম্পদের তথ্য চেয়েছিলাম। সেখান থেকে তথ্য এসেছে। আমরা এখন এগুলো যাচাই-বাছাই করব।’
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জি কে শামীমের সম্পদের যে তথ্য এসেছে তাতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সেই সম্পদের কতটা বৈধ কতটা অবৈধ তা তদন্ত করে দেখা হবে। যে সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো এখন তালিকা করে জি কে শামীমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মেলানো হবে। গরমিল পাওয়া গেলে সেসব সম্পদের বিষয়ে জানার জন্য তাঁকে আবারও রিমান্ডে আনা হতে পারে।
পাগলা মিজানের শতকোটি টাকার সম্পদ : সিআইডির রিমান্ডে থাকা ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজান তাঁর সম্পদের তথ্য দিচ্ছেন। গত শনিবার তাঁর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। গতকাল মঙ্গলবার রিমান্ডের তৃতীয় দিন পার হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাগলা মিজান মোহাম্মদপুর এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল করে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার ‘বি’ ব্লকে পাগলা মিজান সরকারি জমি দখল করে স্বপ্নপুরী হাউজিং কমপ্লেক্স নামের একটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন। সেখানে তিনটি ভবনে তাঁর ২৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এগুলোর মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরো ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন তিনি। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে ৩০ কাঠার একটি প্লট দখল করে তিনি মার্কেট করেন বলে তথ্য মিলেছে। মোহাম্মদপুর সমবায় মার্কেট ও জেনেভা ক্যাম্পের টোল মার্কেটও তাঁর দখলে। সিটি করপোরেশনের নাম করে এসব মার্কেট থেকে তিনি মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলেন। এসব করে তিনি নয়াপল্টনে ছয়তলা বাড়ি করেছেন, মোহাম্মদপুরে ১০ কাঠা এবং গাজীপুরে ৩৫ কাঠার প্লট কিনেছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, ১৫ বছর ধরে মিজানের কোনো বৈধ আয়ের উৎস নেই। অথচ এ সময়ে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তিনি বাড়ি কিনেছেন। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো নির্মাণকাজ করতে হলে তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হতো। জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
গত শুক্রবার ভোরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একটি বাড়ি থেকে মিজানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তিনি সীমান্ত হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চারটি গুলি ও দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই দিন মিজানকে নিয়ে তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র এবং ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকা লেখাসংবলিত চেক উদ্ধার করা হয়েছে। মিজানের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে শ্রীমঙ্গল থানায় এবং মানি লন্ডারিং আইনে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করা হয়েছে।