নিজের শত বিঘা জমি ও ঘরবাড়ি দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মালিক তার তত্ত্বাবধায়ককে। কিন্তু মালিক মারা গেলে সেই তত্ত্বাবধায়কই মালিকের বাড়িঘর ও জমিজমা দখল নিয়েছেন। মালিকের সম্পদ দখল করে সাধারণ একজন তত্ত্বাবধায়ক থেকে এখন তিনি কোটিপতি বনে গেছেন। প্রভাবের সাথে মালিকের ভিটেতেই শক্ত শেকর গড়ে তুলেছেন এই চৌকশ তত্ত্বাবধায়ক। এমনকি মালিকের সন্তানরা জমিজমা বুঝে নিতে বাবার পৈত্রিক ভিটেতে গেলেই তিনি তার লোকজন নিয়ে হামলা করে বসেন। এই তত্ত্বাবধায়কের নাম জসিম উদ্দিন আর মালিকের নাম আমিরুজ্জামান। ঘটনাটি ঘটেছে দেশের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের রসেয়া এলাকায়। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার শালিস হয়েছে, থানায় সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু কোনটিই মানেনি ওই তত্ত্বাবধায়ক। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার আটোয়ারী থানায় জসিম উদ্দিন ও তার সন্তানসহ সহযোগিদের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
অভিযোগ ও স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, জেলার আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের রসেয়া এলাকার সম্ভান্ত পরিবার বড়বাড়ির কাঈম উদ্দিনের ছেলে আমিরুজ্জামান। আমিরুজ্জামানাদের ৩ মেয়ে। বড় মেয়ে রওনক জাহান, মেজ মেয়ে জাফরীন জাকিয়া খাতুন ও ছোট মেয়ে শাহিদা জাহান। আমিরুজ্জামান তার সম্পদ দেখাশুনার জন্য প্রায় ১০ বছর আগে কিসমত রয়েসা এলাকার সিরাজ উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করে। তাকে রসেয়ার নিজ একতলা ফ্লাট বাড়িটিও পরিবার নিয়ে থাকতে দিয়ে তিনি পঞ্চগড় জেলা শহরের বাড়িতে থাকতেন। এর আগে জসিম দীর্ঘদিন ধরে আমিরুজ্জামান ও তার বড় ভাই বদিউজ্জমানের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের মার্চে আমিরুজ্জামান মারা যান। ওই বছরের আমিরুজ্জামানের স্ত্রী উম্মে তাহেরা খাতুন ও বড় মেয়ে রওনক জাহান মারা যান। শুরুতে জমি জমার হিসেব নিকেশ ঠিকভাবে দিলেও আমিরুজ্জামান ও স্ত্রী মারা যাওয়ার পর টালবাহানা শুরু করে জসিম। আমিরুজ্জামানের দুই মেয়ে হিসেব নিকেশ চাইলে তাদের উল্টো হুমকি দেয়া হয়। ক্রমেই ওই বাড়িসহ আমিরুজ্জামানের সকল সম্পদ দখল করে বসে জসিম উদ্দিন। দখল পাকাপোক্ত করতে স্থানীয় প্রভাবশালীদেরও ম্যানেজ করে নেয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, জমিজমা বুঝে নিতে নিজের বাবার পৈত্রিক ভিটায় যাওয়া মাত্রই ওই জসিম উদ্দিন ও তার সহযোগিদের হামলার শিকার হতে হয়। এ নিয়ে আগেও অনেক বিচার শালিস হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জসিম তার দখলদারিত্বে শেকর আরও পাকাপোক্ত করেছে। গত বুধবার সকালে আমিরুজ্জামানের মেজ মেয়ে জাফরীন জাকিয়া তার স্বামী ও আমিন নিয়ে জমি বুঝে নিতে ওই এলাকায় গেলে রাস্তাতেই তাদের আটক করে জসিম উদ্দিন ও তার ছেলেরা। পরে তর্কের এক পর্যায়ে লাঠি শোঠা দিয়ে তাদের মারধর শুরু করে। মোবাইল ও ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে স্থানীয়রা জাফরীন জাকিয়া, তার স্বামী কামরুজ্জামান, তাদের প্রাক্তন আধিয়ার আব্দুল গফ্ফার ও তার স্ত্রী পারভীন আক্তারকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে জসিমরাও ৪ জন ওই হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার আটোয়ারী থানায় একটি অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী জাফরীন জাকিয়া খাতুন।
জাফরীন জাকিয়া খাতুন বলেন, আমার বাবার পৈত্রিক ভিটায় আমি যেতে পারছি না। আমাদের বাড়ি ও জমিজমা সব কেয়ারটেকার জসিম উদ্দিন দখল করে ফেলেছে। আমাদের কোন জমিই বুঝে দিচ্ছে না। জমিতে গেলেই তারা হামলা করে। এর আগে থানায় বসে তারা আমাদের সব জমি বুঝিয়ে দিবে বলে স্বীকার করলেও তা আজও করেনি। সে বার বার প্রশাসনকে অবমূল্যায়ন করছে। আমার বাবার ৩২ একর জমি রেখে গেছেন। তার মধ্যে আমাদের ভাই না থাকায় ১২ একর চাচা ও ফুফুরা পাবেন। বাকি ২০ একর আমরা বোনরা পাবো। কিন্তু জসিম আমাদের অংশের সব জমিই দখল করে রেখেছে। জমি থাকতেও আমরা জমিতে যেতে পারছি না। এমনকি নিজের পৈত্রিক বাড়িতেও যেতে পারছিনা। গেলেই লোকজন নিয়ে মারধর করছে। এতিম বলে আমাদের সাথে তারা আজ এমন করতে পারছে। যাকে আমার বাবা আশ্রয় দিলো, চাকরি দিলো আজ সেই আমাদের সব দখল করে নিচ্ছে। আমরা থানায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেই প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।
অভিযোগ অস্বীকার করে জসিম উদ্দিন বলেন, আমিরুজ্জামান আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। বাড়িটি খাস জমিতে রয়েছে। এছাড়া আমি তাদের সম্পদ দখল করেছি এটা মিথ্যে। আমিরুজ্জামানের স্ত্রী ও ছেলে না থাকায় ভাই ও বোনদের অংশের ৩ একর ৬৬ শতক জমি কিনে নিয়েছি মাত্র। সেটুকুই আমার দখলে আছে।
আটোয়ারী থানার ওসি ইজার উদ্দিন বলেন, তাদের মধ্যে জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। এর আগে থানায় সমঝোতা করে দেয়া হলেও তারা মানছে না। আমি ৩টি অভিযোগ পেয়েছি। দুটি অভিযোগ জসিমের বিরুদ্ধে এবং ১টি অভিযোগ জাফরীন জাকিয়াদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।