মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হওয়ার পর এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেনেটে বিচারের মুখোমুখি হবেন দুটি অভিযোগে।
একটি অভিযোগ হচ্ছে, মি: ট্রাম্প তার পদকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
অন্যটি হলো, অভিশংসনের তদন্তে তিনি কংগ্রেসের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভস-এ অভিশংসন হওয়া তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সেখানে ভোটে সদস্যরা প্রায় সকলেই তাদের দলের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে ভোট দিয়েছেন। শুধু পাঁচজন বাদে যারা সবাই ডেমোক্র্যাট।
তবে রিপাবলিকানরা সবাই অভিশংসনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। এরপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেনেটে বিচারের মুখোমুখি হবেন।
সেখানে পরাজিত হলে আগামী নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে পদচ্যুত হবেন তিনি। কিন্তু উচ্চকক্ষ সেনেটে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই সেখানে ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই বেশি।
পদচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা কম কেন?
সেনেটে কোন প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করতে হলে সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ ভোটের দরকার। উচ্চকক্ষে এখন একশটি আসনের মধ্যে ৫৩টি রিপাবলিকানদের।
প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করতে ডেমোক্র্যাটদের দরকার ৬৭টি ভোট। এটি সম্ভব করতে হলে ডেমোক্র্যাট পার্টির ৪৫টি ভোটের সবকটি অভিশংসনের পক্ষে হতে হবে, দুইজন স্বতন্ত্র সেনেটরের ভোটও পক্ষে পেতে হবে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ২০ জন রিপাবলিকানকে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে হবে।
রিচমন্ড স্কুল অফ ল’র অধ্যাপক কার্ল টোবাইয়াস বলছেন, এতো ভোট নিশ্চিত করতে পারার সম্ভাবনা কম।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। তাদের নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেবার কথা।
কিন্তু সেনেট নেতা রিপাবলিকান দলের মিচ ম্যাককনেল ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছেন যে তিনি এই ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে যুক্তিতর্ক শুনবেন না।
তিনি এই অভিশংসন প্রক্রিয়াকে পুরোটাই পক্ষপাতমূলক বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, “হাউজ অফ রেপ্রেজেনটেটিভস অভিশংসনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা পুরোটাই রাজনৈতিক। আমি ধারনা করছি সেনেটের ফলাফলও দলের পক্ষেই যাবে।”
অধ্যাপক টোবাইয়াস বলছেন, দল কেন্দ্রিক বিভাজন ‘দুশ্চিন্তার’ বিষয়।
তিনি বলছেন, “রিপাবলিকানদের অনেকেই কোন ধরনের তথ্য প্রমাণ না দেখে, শুনানিতে যুক্তিতর্ক বা আলোচনা না শুনে ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে তারা কোন দিকে ভোট দেবেন। তাদের নিরপেক্ষ জুরির মতো কাজ করার কথা এবং তারা যদি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তাহলে বিষয়টি উদ্বেগের।”
ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এর আগে মাত্র দুই প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হয়েছেন। তাদের একজন ১৮৬৮ সালে অ্যান্ড্রু জনসন।
অন্যজন ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। কিন্তু তারা দুজনেই সেনেটে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।
নির্বাচনের বছরে ট্রাম্পকে অভিশংসনের উদ্যোগ ডেমোক্র্যাটদের জন্য রাজনৈতিকভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ।
অভিশংসন হওয়ার ফলে আগামী নির্বাচনে হয়ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আবার একই সাথে সেসব এলাকায় ট্রাম্পের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে, সেখানে ডেমোক্র্যাটদের জন্য নির্বাচনে জেতা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু তবুও এমন ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল নিয়ে কেন সামনে এগুচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা?
সংবিধানকে সুসংহত করা
ডেমোক্র্যাট জাতীয় কমিটির সদস্য জুলিয়া ব্রায়ান বলেছেন, “আমাদের সংবিধানকে সুসংহত করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা পরিষ্কার যে অভিশংসন হওয়ার মতো অপরাধ হয়েছে। আমরা যদি এগিয়ে না যাই তাহলে ভবিষ্যতে তা একটি ভয়াবহ নজির হয়ে থাকবে।”
তিনি আরও বলেছেন, “এটি আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কংগ্রেস এমন পরিষ্কার তথ্য প্রমাণ উপেক্ষা করতে পারে না। যা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে তিনি প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে ইউক্রেনে একটি জ্বালানি কোম্পানিতে কর্মরত তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনের উপরে চাপ দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনকে দেয়া বেশ বড় অংকের মার্কিন সামরিক সুবিধা আটকে দেয়ার হুমকি দিয়ে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেছেন।
অভিশংসনের ব্যাপারে ভোটাভুটির সামনে রেখে নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে ক্ষুব্ধ চিঠি লিখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি তাতে লিখেছেন তাকে অভিশংসনের উদ্যোগ “মার্কিন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা”।
অধ্যাপক টোবাইয়াস বলছেন, “ডেমোক্র্যাটরা মনে করছে তারা যে শপথ নিয়েছে সেজন্য তাদের উপর দায়িত্ব বর্তায় বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। তারা মনে করছে ট্রাম্প যে আবার শপথ ভঙ্গ করবেন না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে আমার মনে হয় ডেমোক্র্যাটদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হল তিনি (ট্রাম্প) আগামী নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা করতে পারেন।”
অভিশংসনের সাথে নির্বাচনের সম্পর্ক
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল ম্যানেজমেন্টের পরিচালক টড বেল্ট অভিশংসনের সাথে আসছে নির্বাচনের সম্পর্ক নিয়ে আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন।
তিনি বলছেন, “ডেমোক্র্যাটরা ভাবছে তারা যদি এই বিষয়টি নিয়ে না এগোয় তাহলে তাদের ভোটাররা কী ভাববে? তারা যদি এটা না করে তাহলে তাদের জন্য নির্বাচিত হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। অন্যদিকে রিপাবলিকানরাও ভাবছে, তারা যদি প্রেসিডেন্টকে সমর্থন না দেয় তাহলে তাদের জন্যও পুনঃ নির্বাচিত হওয়া মুশকিল হবে।”
বিবিসির উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যান্থনি জারকার-এর ভাষ্যমতে, “ডেমোক্র্যাট শিবিরে লম্বা সময় ধরে ট্রাম্পের অভিশংসনের ব্যাপারে জোর দাবি চলেছে। ডেমোক্র্যাট নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি কোন পদক্ষেপ না নেয়, তাতে সবচেয়ে অনুগত সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারেন।”
ট্রাম্পকে আত্মরক্ষার অবস্থানে রাখা
ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে অভিশংসনের মাধ্যমে এক ধরনের আত্মরক্ষার অবস্থানে রাখার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্ত ইতোমধ্যেই তার ব্যবসা বাণিজ্যকে এক ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
বিশেষ করে তার আইনজীবী, নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানিকে। ইউক্রেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারি ইওভানোভিচকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে হচ্ছে।
তিনি মনে করেছেন মিজ ইওভানোভিচ ট্রাম্প বিরোধী মনোভাব পোষণ করেন।
অধ্যাপক বেল্ট বলেন, “ইউক্রেনে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, মি. জুলিয়ানি এবং অন্যান্য সহযোগীরা আদালতে বিচারের মুখে পরতে পারেন। হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ব্যাবসায়িক কার্যক্রম নিয়েও আরও মামলার সম্মুখীন হতে পারেন।”
তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অভিশংসন ছাড়াও আরও কিছু পথ বেছে নিতে পারেন ডেমোক্র্যাটরা।
ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যদি আরও নেতিবাচক তথ্য বের হয় তাহলে তা তার জন্য সত্যিই ক্ষতিকর হবে।
ভোটারদের মত কী পরিবর্তন হবে?
ডেমোক্র্যাটরা মনে করছেন, অভিশংসনের পরবর্তী ধাপ সাধারণ মানুষের আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
জনমত জরিপপে দেখা গেছে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত একদম সমান সমান।
ওয়াশিংটন পোষ্ট এবং টিভি চ্যানেল এবিসি’র সর্বশেষ জরীপে দেখা গেছে, ৪৯ শতাংশ অভিশংসনের পক্ষে। ৪৬ শতাংশ এর বিপক্ষে। বাকিদের কোন মত নেই।
অধ্যাপক বোল্ট বলেন, “নিক্সনের সময় ডেমোক্র্যাটরা খুব ধীর গতিতে এগিয়েছিল। তখন পর্যায়ক্রমে অল্প অল্প তথ্য আসছিলো। যার কারণে শেষ পর্যন্ত নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিলো।”
তিনি মনে করছেন, সেরকম হলে ডেমোক্র্যাটরা হয়তো আরও শক্ত তথ্য প্রমাণাদি পেতো। কিন্তু তারা এবার খুব দ্রুত সবকিছু শেষ করতে চাইছে যাতে করে তারা নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে পারে।”
BBC