কিছুদিন আগে থেকেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের সব পন্থাই কার্যত অচল। শুধু টিকে আছে ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে চলার প্রচারণাটুকু। এর বাইরে এখন সব কিছুই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের টিকা ঘিরে। অন্য সব ছাপিয়ে এখন শুধুই চলছে কিভাবে টিকা সংগ্রহ করা হবে, কিভাবে তা প্রয়োগ করা হবে—এসব পরিকল্পনা। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর পর্যন্ত সবাই এই বিষয়ে সক্রিয়। বিশেষজ্ঞরা যেমন অন্য সব পরিকল্পনা থেমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তেমনি সাধুবাদ জানাচ্ছেন টিকা ঘিরে সরকারের সক্রিয় অবস্থানকে।
আগে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে তেমন সক্রিয় হতে দেখা না গেলেও টিকা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও অধিকতর তৎপর হয়ে উঠেছে। যেসব দেশে টিকা নিয়ে অগ্রগতি বেশি হচ্ছে, সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর টিকা সংগ্রহে যেখানে অর্থের প্রয়োজন পড়বে, সেখানে সক্রিয় অর্থ মন্ত্রণালয়। মূলত বাস্তবায়ন ঘিরে প্রায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
টিকার ব্যাপারে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এবার রাশিয়ার দিকেও নজর দিয়েছে সরকার। রাশিয়ার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে।
করোনা প্রতিরোধে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা আমাদের অবশ্যই দরকার। যত দ্রুত টিকা পেয়ে যাব, ততই আমরা করোনা থেকে দ্রুত মুক্তি পাব। নয়তো সংক্রমণ ভোগান্তি আরো দীর্ঘতর হতে থাকবে। সেদিক থেকে সরকার যেভাবে সক্রিয় হয়েছে, এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু অন্য সব প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ এড়িয়ে কেবল টিকা নিয়েই যে এখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেটাকে সমর্থন করা যাবে না।’
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে—টিকা হচ্ছে অন্যতম একটি রক্ষাকবচ, কিন্তু একমাত্র নয়। বরং টিকার পাশাপাশি এখনো আমাদের সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে যে কাজগুলো করতে হবে তা হচ্ছে, মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেই কৌশল বাস্তবায়ন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, কন্টাক্ট ট্রেসিং চালু করা এবং আইসোলেশন নিশ্চিত করা। এগুলো না করে কেবল টিকা নিয়ে পড়ে থাকলে ফল ভালো হবে না। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসব।’
গত সোমবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘দেশে টিকা আনতে সরকারের কভিড-১৯ সংক্রান্ত সব শাখা তৎপর রয়েছে। এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত খোঁজ নিচ্ছেন। এই টিকাগুলোর গুণগত মান যাচাই-বাছাই করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবেন।’
একই দিন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন মূলত টিকার ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, টিকার জন্য এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং এসব দেশের টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতিও হয়েছে। সেই সঙ্গে জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।
অন্যদিকে দেশে টিকা আসার পর তা মানুষের মধ্যে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, তা নিয়েও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে পরিকল্পনার কাজ। বর্তমান সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রম (ইপিআই) ব্যবহার করেই মাঠ পর্যায়ে টিকা প্রয়োগ করার প্রস্তুতি চলছে। চলছে এসব কাজে দক্ষ জনবল তৈরির কাজও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু) ডা. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের ইপিআই কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা ও জনবলকে এবার করোনার টিকা প্রয়োগের বড় শক্তি হিসেবে মনে করছি। তবে এই জনবলকে কিভাবে করোনার টিকার জন্য দক্ষ করা হবে, সে জন্য গাইডলাইন তৈরি হচ্ছে। ওই গাইডলাইন অনুসারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আমরা এখনো জানি না কোন টিকা আগে আমরা পাব, সেই টিকা কয় ডোজের হবে, কোন বয়সীদের মধ্যে দেওয়া যাবে। এসব বিষয় আরো পরিষ্কার হতে কিছুটা সময় লাগবে।’ প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে একটি সফটওয়্যার তৈরির কাজ শুরু করেছি, যা টিকা প্রয়োগ বাস্তবায়নে অনেক সহায়তা করবে। এ ছাড়া আমরা টিকা মজুদ, পরিবহন ও বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রস্তুতি যেগুলো আগেভাগে নেওয়া সম্ভব, সেগুলো নিতে শুরু করে দিয়েছি।’