করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় শুধু দেশীয় সরবরাহকারীরাই যে নানা ক্ষেত্রে নয়ছয়ের মচ্ছবে মেতেছে, তা-ই নয়; এর সুযোগ ছাড়েনি ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও। এ দুই প্রতিষ্ঠান বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশকে যেমন করোনা মোকাবেলায় বিনা মূল্যে সাহায্য-সহযোগিতা আগের মতোই দিয়েছে, তেমনি এবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে রীতিমতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আদলে বাণিজ্যিক চুক্তি করে পণ্য সরবরাহে যুক্ত হয়েছে। আবার জরুরি কার্যক্রমের আওতায় এসব পণ্য সরবরাহের কথা থাকলেও গত দুই মাসেও এসব বুঝিয়ে দিতে পারেনি সংস্থা দুটি। চুক্তিতে একটি প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক ‘দৈবখরচ’ (আকস্মিক বা অনির্ধারিত খরচ) যোগ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ইউনিসেফ ১৬টি আইটেমের ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫০৩ ইউএস ডলার মূল্যের সঙ্গে প্রায় ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত বিভিন্ন খরচ যুক্ত করে মোট ব্যয় ধরেছে ৯১ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৭ ইউএস ডলার। এই বাড়তি আনুষঙ্গিক ব্যয়ের হিসাবের মধ্যে স্বাভাবিক আনুষঙ্গিক আমদানি-রপ্তানি ফি, ইনস্যুরেন্স, হ্যান্ডেলিং ও পণ্য মূল্যের জন্য দৈবখরচ বাদেও আরো ২০ শতাংশ দৈবখরচ ধরা হয়েছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) চুক্তিতে এই খাতে কোনো খরচ ধরা হয়নি।
এসংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত কভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারেশন প্রজেক্টের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশীয় কিছু সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ইউনিসেফের সঙ্গে ক্রয়সংক্রান্ত একটি চুক্তি করে। গত ৮ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং ইউনিসেফের বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমো হুজমির চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মেয়াদ রাখা হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এর আওতায় করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, বডি ব্যাগ, পিপিইসহ ১৬টি আইটেম সরবরাহের জন্য দরপত্র দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। দরপত্রে এসব পণ্য সরবরাহের জন্য সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয়েছে ৯১ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৭ দশমিক ৫০ ইউএস ডলার। এর মধ্যে শুধু ১৬টি আইটেমের পণ্যের মোট দাম ধরা হয়েছে ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫০৩ দশমিক ০২ ডলার। এর সঙ্গে আমদানি, ইনস্যুরেন্স ও পরিদর্শন ফি ধরা হয়েছে ২৮ লাখ তিন হাজার ৯৪১ দশমিক ২২ ডলার, পণ্যসামগ্রীর মোট দামের ওপর ৬ শতাংশ কন্টিজেন্সি বাফার (দৈব খরচ) ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ২৭০ দশমিক ১৯ মার্কিন ডলার, সেই সঙ্গে পণ্যের দামের মোট ৫ শতাংশ হ্যান্ডেলিং ফি বাবদ ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার ৭২৫ দশমিক ১৫ ডলার। সব মিলিয়ে খরচ আসে ৭৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৯ দশমিক ৫৮ ডলার। এই মোট খরচের ওপরে আবার বাড়তি ২০ শতাংশ কন্টিজেন্সি (দৈব) বাবদ ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৪৮৭ দশমিক ৯২ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
ইউনিসেফের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি অনুসারে ১৬টি আইটেম পণ্যের দাম ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ডলার, আর ওই পণ্য বাবদ অন্যান্য খরচ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ১০ হাজার ডলার
ইউনিসেফের চুক্তির আওতায় প্রথম ধাপে ৪৫০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর জুন-জুলাই মাসের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বুঝে পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অন্যদিকে ডাব্লিউএইচওর সঙ্গে গত জুন মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি হয় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩০ লাখ টেস্টিং কিট সরবরাহ করার। এই বাবদ খরচ ধরা হয় ২৯ লাখ ২৩ হাজার ১৫১ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এক লাখ ৭০ হাজার ২০০ কিট জুন মাসের মধ্যে সরবরাহের কথা, জুলাই মাসে আরো এক লাখ ৯১ হাজার ৬৭০ কিট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনোটাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝে পায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার হয়তো বিপদে পড়েই এ ধরনের সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিছু পণ্য কিনছে। সেই সুযোগ নিয়ে যদি কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা নিয়মিত স্বাভাবিক দৈব খরচের পরও আরো ২০ শতাংশ অতিরিক্ত দৈব খরচ ধরে থাকে, সেটা নৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে সরকারের আরো সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।’
এসব প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যতটুকু জানতে পেরেছি তা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তির আওতায় জরুরি কিছু সরঞ্জাম ক্রয়সূত্রে সরবরাহের কার্যাদেশ ছিল। যার কিছু অংশ জুন মাসে আবার কিছু জুলাই মাসের মধ্যে সরবরাহের কথা ছিল। এখন পর্যন্ত এর বেশির ভাগই বুঝে পাইনি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরও একাধিকবার তাগাদা দিয়েছি।’
মহাপরিচালক বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গত জুন পর্যন্ত কভিড সরঞ্জাম আনা ট্যাক্স ফ্রি ছিল। এরপর পণ্য ছাড় করতে ট্যাক্স দিতে হবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে। ইউনিসেফ পণ্য সরবরাহে দেরি করে এখন আমাদের ছাড়িয়ে নিতে বলছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ ছাড়া জাদিদ অটোমোবাইলস, মাসিমো ও ওশান এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও বিভিন্ন ধরনের বিপুলসংখ্যক পণ্য এখন পর্যন্ত বুঝে পায়নি। জাদিদ অটোমোবাইলস নামের প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া কার্যাদেশ অনুসারে জুন মাসের মধ্যেই ৫০ হাজার এন ৯৫ মাস্ক, দেড় লাখ কেএন ৯৫ মাস্ক, ৫০ হাজার পিস পিপিই; মাসিমো ইন্টারন্যাশনালকে কার্যাদেশ অনুসারে দুই ধাপে দুই হাজার প্লাস অক্সিমিটার; ওশান এন্টারপাইজের দুই ক্যাটাগরির ৩০০টি ভেনটিলেটর জুন-জুলাই মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু মাস্ক ও পিপিই ছাড়া কিছুই হাতে পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কোনো কোনো পণ্য দেশে এসেছে বলে আমরা শুনেছি, আবার কিছু দেশেই আসেনি। যেগুলো দেশে এসেছে সেগুলো দিনের পর দিন বন্দরের কাস্টমসে পড়ে থাকায় ট্যাক্স ও ফির পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, যা ছাড়ানোও কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত ছাড়িয়ে দিতে বলেছি ধার্যকৃত দৈব খরচের খাত থেকে। কিন্তু কেউ কেউ তাতে রাজি হচ্ছে না। আবার আমাদেরও এত টাকা দিয়ে ছাড়ানোর উপায় নেই।’
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ইউনিসেফের সহায়তায় লিন্ডা গ্রুপের ৪০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার ও কিছু মাস্ক বুঝে পেয়েছি। আরো কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে বলে শুনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত (গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত) ইউনিসেফের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রের কোনো অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর বুঝে পাইনি।’
এসব পণ্য কেনাকাটার চুক্তি ও কার্যাদেশ দেওয়ার সময় কভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারেশন প্রজেক্ট পরিচালক ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (উন্নয়ন) ডা. ইকবাল কবীর। এসব কেনাকাটায় অতিরিক্ত দামসহ আরো কিছু বিষয়ে অভিযোগের মুখে গত মাসে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ডা. ইকবাল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই সময় আমি দায়িত্বে থাকলেও চুক্তি হয়েছে মহাপরিচালকের সঙ্গে। আমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চুক্তি অনুসারে পণ্য বুঝিয়ে দিয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার কাছ থেকে যেসব সহায়তা চেয়েছেন, আমি তা দিয়েছি।’
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে এ বিষয়ে জানতে ফোন করে এবং ই-মেইল পাঠিয়েও গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।