আট বছর আগে রাজধানীর গোপীবাগে ইমাম মাহাদির ‘প্রধান সেনাপতি’ দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। এর দুই বছর পর ২০১৫ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) বলেছিল, এই ছয় খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তখন ওই মামলায় জেএমবির ছয় জঙ্গিকে গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। যদিও ২০১৯ সালে এসে ডিবি জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া ওই জঙ্গিরা ছয় খুনে জড়িত নয়।
এখন মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগ বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা ছয় খুন ঘটিয়েছে। তবে জেএমবির শীর্ষ দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় মামলার তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোপীবাগের নিজ বাড়িতে খুন হন লুৎফর রহমানসহ ছয়জন। তাঁর সঙ্গে ওই দিন হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যরা হলেন লুৎফরের ছেলে সারোয়ার ইসলাম, লুৎফরের অনুসারী মনজুর আলম, মো. শাহিন, মো. রাসেল ও মজিবর সরকার। খুনিরা বাড়ির নারীদের অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল। এ বাইরে থাকায় লুৎফরের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক বেঁচে যান। তিনি ওয়ারী থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলার অগ্রগতি না থাকায় কাছে হতাশার কথা জানান বাদী আবদুল্লাহ আল ফারুক। তিনি প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালে কাউন্টার টেররিজম বিভাগ তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে পাঁচবার। তিনি সপ্তম তদন্তকারী কর্মকর্তা। হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি, তাই তদন্তও শেষ হচ্ছে না।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেররিজম বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ছয় খুনের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে এখন পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আজমির, গোলাম সারোয়ার ওরফে রাহাত, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে জিতু, আল আমিন, তরিকুল ইসলাম, আবদুল গফফার, হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও আবু রায়হান মাহমুদ। রিমান্ড শেষে তাঁরা এখন কারাগারে আছেন। এঁদের মধ্যে তরিকুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলায় মামুনুর ও হাদিসুরকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।
পুলিশ বলছে, জেএমবির বর্তমান আমির সালাউদ্দিন সালেহীনের নির্দেশে গোপীবাগে ছয় খুনের ঘটনা ঘটে। সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন জঙ্গি নেতা ফারুক ওরফে জামাই ফারুক। পশ্চিমবঙ্গে খাগড়াগরে বোমা বিস্ফোরণ মামলার আসামি এই জঙ্গি নেতা গ্রেপ্তার হয়ে সেখানকার কারাগারে আছেন। তদন্তে ছয় খুনে অনেক জঙ্গির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন, নাঈম, রমজানসহ আরও কয়েকজন পালিয়ে আছেন। ছয় খুনে অংশ নেন জঙ্গি হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহে প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মাহমুদ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান। আরেক আসামি রাইসুল ইসলাম ওরফে ফারদিন বগুড়ায় জঙ্গি আস্তানায় বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে মারা যান।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ইমাম মাহাদির প্রধান দাবি করা লুৎফর রহমান নিজস্ব মতবাদ প্রচার করে আসছিলেন। তিনি ‘শিরক’ করছেন বলে ক্ষুব্ধ হয়ে জঙ্গিরা তাঁকে খুন করে।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গোপীবাগের ছয় খুনের পর জেএমবি তাদের ওয়েবসাইটে এর দায় স্বীকার করে। জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন ও জামাই ফারুককে আইনের আওতায় আনা গেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ছয় খুনে কতজন অংশ নিয়েছে, কার কী ভূমিকা ছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাদের কারণে মামলার তদন্তকাজও আটকে রয়েছে।