একই খেলোয়াড়, প্রতিপক্ষও এক—কিন্তু লড়াইয়ের ধরনটা ভিন্ন। এই লড়াই চোখে চোখ রেখে ঘায়েল করে ফেলার আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তাতে করে প্রতিপক্ষের ওপর উল্টো মানসিক চাপটা চলে যায়। যেমনটা গত ম্যাচে ভারতের হয়েছে। অথচ একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের লড়াইটা ছিল অনেকটাই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে। প্রতিজ্ঞা ছিল, শক্তি ছিল, তবু যেন ফলটায় চোখ রাখতে পারছিল না বাংলাদেশ। লড়াই করব, এরপর যা হয় হবে—এই ছিল মনোভাব। কিন্তু অস্কার ব্রুজোন বোঝাচ্ছেন—ওই ফলটা আমার চাই, তার জন্য সবই করব।
তাতেই শেষ মুহূর্তে বারবার গোল হজম করে ভগ্ন হৃদয়ে ফেরা বাংলাদেশ এখন পেছনে পড়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ঠিক ফিরে আসে। বসুন্ধরা কিংস কোচ ব্রুজোন জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর খুব দ্রুত এই রূপান্তর। দারুণ ব্যাপার হলো, খেলোয়াড়রা নিজে কখন এই পরিবর্তনে বদলে গেছেন টেরই পাননি যেন। এভাবেই যেন তাঁরা সব সময় খেলছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁদের মনের আড়ালে থাকা চাওয়াটাই কোচ বের করে নিয়ে আসতে পেরেছেন বলেই হয়তো। গোলরক্ষক আনিসুর রহমান যেমন বলেছেন, ‘আমরা যে মানের খেলোয়াড়, আমাদের দিয়ে যে পাসিং ফুটবল সম্ভব—কোচ এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া আমাদের যে র্যাংকিং, এটাও আমাদের সামর্থ্যের কথা বলে না। আমরা আরো ভালো কিছু করতে পারি, এই বিশ্বাসটা এখন তৈরি হয়েছে।’
অস্কার ব্রুজোন খেলার ধরনেও এই গুণগত পরিবর্তনটা এনে খেলোয়াড়দের বিশ্বাসের জায়গা পোক্ত করেছেন। ৪-১-৪-১ ছকে যেমন এক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জামাল ভুঁইয়ার ওপরে চার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার খেলিয়েছেন তিনি। জেমি ডে’র সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সাহসটা করতে পারত না বাংলাদেশ। জামালের সঙ্গে আরো একজন রক্ষণাত্মক মানসিকতার মিডফিল্ডার থাকতেন। কিন্তু আক্রমণাত্মক ধরনে দেখা যাচ্ছে ভারতের মতো দলও উল্টো চাপে পড়ে গেছে। তাদের কোচ যেমন বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই নার্ভাসনেস কাজ করেছে তাঁর খেলোয়াড়দের মধ্যে।
মতিন মিয়া ভারত ম্যাচের জন্য তৈরি হওয়া নিয়ে যেমন বলছিলেন, ‘ভারত অনেক ভালো দল কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কোচ আমাদের এমনভাবে উজ্জীবিত করেছেন যে মনে হয়েছে ওরা কিছুই না। সত্যিকার অর্থে আমরা খেলেছিও সেভাবে।’ দলের সঙ্গে থাকা ম্যানেজার ও সাবেক ফুটবলার সত্যজিৎ দাসও খেলার ধরনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ‘জেমি যখন ছিল, তখনো যে ইতিবাচক মানসিকতাটা ছিল না তা নয়, কিন্তু এখন খেলার ধরনটাই ভিন্ন। এখন বল পায়ে রেখে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে পারছে এই দলটা।’ সন্দেহ নেই টুর্নামেন্টের বাকি দুই ম্যাচ মালদ্বীপ ও নেপালের বিপক্ষেও একই ধরনে যাবে বাংলাদেশ। এই ধরনে ভারত ম্যাচটাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল, সেটি উতরে যাওয়ার পর মালদ্বীপ ও নেপালের বিপক্ষে সেখান থেকে সরে আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। আনিসুর তেমনটাই বলেছেন, ‘গত দুই ম্যাচে আমরা যেমন ইতিবাচক ফুটবল খেলেছি, তাতে দলের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। আমরা সামনের ম্যাচগুলোতেও এটা ধরে রাখতে চাই।’
কোচ হিসেবে ব্রুজোনের অনুপ্রেরণার পাশাপাশি তাঁর অভিজ্ঞতাও নিশ্চিতভাবে বড় কাজ দিচ্ছে এই দলের। এই মালদ্বীপে নিউ র্যাডিয়েন্টকে একাধিক শিরোপা জিতিয়ে বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের হয়েও সেই ঝাণ্ডা উড়িয়ে চলেছেন। এর মধ্যে এই মালেতেই এএফসি কাপ যখন খেলতে এসেছেন, তাঁর দলকে হারাতে পারেনি কেউ। আর এবারের সাফেও এখনো পর্যন্ত অপরাজিত তাঁর দল।
ব্রুজোন নিজে আত্মবিশ্বাসটা কোথা থেকে পান, তাঁর ট্র্যাক রেকর্ডটা ঘাঁটলেই জানা যাচ্ছে। পুরো দলকে যেমন, তেমনি ব্যক্তিগতভাবেও খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনাতেও দক্ষ তিনি। এর আগের সাফে মতিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জোড়া গোল করেছিলেন ঠিক, কিন্তু পরশু ভারতের বিপক্ষে বল পায়ে তাঁকে যতটা সাবলীল দেখিয়েছে, জাতীয় দলের জার্সিতে এমনটা দেখা গেছে কমই। মতিন নিজেও উপভোগ করছেন ব্রুজোনের দর্শনে জাতীয় দলেও নিজেকে মেলে ধরতে পেরে, ‘সত্যিকার অর্থে ব্রুজোনের এই ধরনটার সঙ্গেই আমার মিলে যায়। জেমির অধীনে বাড়তি ডিফেন্সিভ ওয়ার্কের জন্য যেটা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। এখন আমি খেলাটা আরো বেশি উপভোগ করছি। আশা করি তাতে আরো ভালো কিছুই হবে।’ মাঝমাঠে জামাল ভুঁইয়াকে জিজ্ঞাসা করলেও এখন হয়তো একই উত্তর পাওয়া যাবে, কিংবা উইঙ্গার মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে। নতুন আত্মবিশ্বাসে ব্রুজোন এভাবেই বদলে দিয়েছেন দলটাকে।