শরীরে ক্ষতিকর জীবাণুর সঙ্গে লড়াইয়ের ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক। এটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। সে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া হলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স। এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য দরকার সচেতনতা। এই সচেতনতা তৈরির জায়গায় গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কালের কণ্ঠ মিলনায়তনে ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সমস্যা : প্রতিকার ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।
kalerkanthoবক্তারা বলেন, অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ ও বিপণন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ ব্যবহার রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, কালের কণ্ঠ, ইউএসএইড এবং সিডিসি যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন কালের কণ্ঠের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। আগে অনেক ওষুধ শরীরে কার্যকর ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেগুলো আর কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যয়ও বহুগুণ বেড়ে যায়। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি কার্যকর নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন সময়সাপেক্ষ বিধায় এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে মো. শহীদুল্লাহ বলেন, সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করে মানুষ, মাছ ও পশু-পাখিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সার্ভেইলেন্স কার্যকরভাবে চালু করতে হবে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ বিক্রেতাদের সচেতন করতে হবে। এ ছাড়া একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখানে জড়ো হয়েছি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে। জনসচেতনতার জন্য গণমাধ্যমগুলোর এ মুহূর্তে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিষয়ে কাজ করা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা ছিল ফরমালিন। কিন্তু আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এতে স্পষ্ট, আমরা চাইলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। আদালতের রায় আছে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করা যাবে না। তার পরও অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, অনেক সময় চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দেন। আবার রোগীরাও অ্যান্টিবায়োটিক চেয়ে নেন চিকিৎসকদের কাছ থেকে। তাই দুই পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের একটি সঠিক দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, রোগ নির্ণয় না করা পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয় এমন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা যথাযথভাবে কাজ করছে কি না সেটা নীতিনির্ধারকদের দেখতে হবে। রোগ নির্ণয় ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক গাইড লাইন অনুসরণ করে সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, যেখানে বেশি বিক্রি বেশি লাভ, সেখানে শুধু সচেতনতা সৃষ্টি করে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মুনাফা যারা করে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্কুল পর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন বলেন, অসুস্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য চিকিৎসকের ওপর রোগীরা চাপ সৃষ্টি করেন—এমন তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই ডাক্তারদের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে। ন্যাশনাল গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নীতিশ দেবনাথ মনে করেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জনগণের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. বারদান জাং রানা বলেন, যারা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন তারা তো বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? তিনি মনে করেন, কোথাও সমন্বয়হীনতা আছে। অ্যান্টিবায়োটিকের দাম এবং সহজলভ্যতাও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির একটি কারণ বলে মত দেন তিনি।
বৈঠকে আরো বক্তব্য দেন খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কান্ট্রি প্রোগ্রাম লিড ইরিক ব্রাম, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এম এ মবিন খান, ইউএসএআইডির গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি স্পেশালিস্ট ডা. মো. আবুল কালাম, ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার, সিডিসি ডা. অনিন্দ্য রহমান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফোকাল ফর এ এম আর মোহাম্মদ রামজি ইসমাইল প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন এমটেপস ইউএসএআইডির কান্ট্রি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডা. জেবুননেছা রহমান।