বাগেরহাটের শরণখোলায় আলু চাষে আগ্রহ কমছে চাষিদের। উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ ও সহজ বাজারজাত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা পাচ্ছে না সরকারি প্রণোদনা। সংরক্ষণ করতে না পারায় আলু নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে কম দামে মাঠ থেকেই বিক্রি করতে হয় তাদের। যার ফলে, লোকসানে পড়ে আলু চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে চাষিরা। চাষিদের দাবি, শরণখোলায় সরকারিভাবে একটি কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন এবং দুর্যোগের ক্ষতিপূরণ পেলে আবার আলু চাষে আগ্রহী হবেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই কৃষিতে বিপ্লব ঘটে উপকূলীয় শরণখোলায়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সিডর বিধ্বস্ত এই জনপদকে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ঘুরে দাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। সেই থেকে এক ফসলি জমিতে বছরে একাধিক ফসল উৎপাদন শুরু করে এ অঞ্চলের মানুষ। প্রথম দিকে কয়েক বছর শরণখোলার মাছে সূর্যমুখী এবং ভুট্টার ব্যাপক চায় হয়। কিন্তু এর বাজারজাত ও এলাকায় চাহিদা কম থাকায় তা এখন আর চাষ হচ্ছে না। তবে, আলু চাষের ধারাবাহিকতা চাষিরা ধরে রাখলেও লোকসানে পড়ে তাও এখন দিন দিন কমছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সিডরের আগেও এলাকায় আলু চাষ হতো। তবে, তা এতটা ব্যাপক বা বাণিজ্যিকভাবে হতো না। সখের বসে হয়তো কিছু চাষি আলু লাগাতো নিজেদের প্রয়োজনে। সিডরের পরেই মূলত আলুসহ অন্যান্য ফসল চাষে ঝুঁকে পড়ে চাষিরা। এভাবে ৭-৮বছর গোটা উপজেলায় ১২০ থেকে ১৩০ হেক্টর জমিতে একটানা চাষ হলেও গত ৩-৪ বছর ধরে তা আবার কমতে শুরু করে। দুই বছর আগেও ১২৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গত বছর হয়েছে ১০০ হেক্টরে। কিন্তু, এ বছর চাষ হয়েছে মাত্র ৮৫ হেক্টর জমিতে। গত বছর ১০০ হেক্টর জমিতে ২২শ’ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যার বাজারমূল্য ছিল ২কোটি ২০লাখ টাকা।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলা মধ্যে আলু চাষের জন্য অন্যতম খোন্তাকাটা ইউনিয়নের মধ্য খোন্তাকাটা ও রাজৈর এলাকার ঘুরে আলু ক্ষেতে সার ও সেচ দিতে দেখা যায় চাষিদের। মধ্য খেন্তাকাটা গ্রামের চাষি জুয়েল হাওলাদার, সোবাহান সেপাই, টিপু সেপাই, মোস্তফা সেপাই স্বপন মোল্লা জানান, তারা ২০ জন চাষি গত বছর ১২০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। জমি চাষ, সেচ, শ্রমিকসহ বিভিন্ন খচর বৃদ্ধি এবং সঠিক দাম না পাওয়ায় এবার ৮০ বিধা জমিতে চাষ করেছেন। তাছাড়া, সৌসুমের শুরুরদিকে অতিবৃষ্টিতে তাদের প্রত্যেকের ৩০হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা সরকারিভাবে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
রাজৈর এলাকার চাষি মো, দুলু তালুকদার জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে আলু চাষ করছেন। প্রথমদিকে ৪-৫ বিঘা জমিতে আলু লাগাতেন। সিডরের পর প্রতি বছর চাষ করতেন ১৫-১৬ বিঘায়। তাদের ওই মাঠে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে আলু চাষ হতো। এবছর চাষ হয়েছে মাত্র ৬০ বিঘায়।
চাষ কমার কারণ হিসেবে দুলু তালুকদার জানান, আলু সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঠ থেকেই কম দামে বিক্রি করতে হয়। এক মণ আলু ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০টাকা দর কাটে পাইকাররা। তাতে উৎপাদন খরচের পর যা লাভ হয় তাতে পোষায় না। গতবছর দুর্যোগ ও অন্যান কারণে তার একারই প্রায় তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। যে কারণে আলু চাষ কমে যাচ্ছে।
চাষিরা জানান, শরণখোলার উৎপাদিত আলু এলাকার চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী মোরেলগঞ্জ, মোংলা, মঠবাড়িয়া, পাড়েরহাট ও ফকিরহাটে বিক্রি করা হয়। কম দামে পেয়ে সেখানকার পাইকাররা এসে মাঠ থেকেই কিনে নিয়ে যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কম দামে বিক্রি করতে হতো না। একটি কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করা হলে আলুসহ অন্যান্য সবজি সংরক্ষণ করে লাভবান হতো চাষিরা। এ ছাড়া, দুর্যোগের ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়া হলে আলু চাষে আবারও বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করেন চাষিরা।
শরণখোলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওয়াসীম উদ্দিন বলেন, এলাকাটি উপকূবর্তী হওয়ায় এখানে বছরে কয়েকবার দুর্যোগ হানা দেয়। যার ফলে ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। এ জন্য আলু চাষে আগ্রহ কিছুটা কমছে চাষিদের। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। তারপরও মাঠপর্যায়ে গিয়ে চাষিদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এখানে কোল্ডস্টোরেজ করা হলে আলুর পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও সংরক্ষণ করা সম্ভব।
কৃষি কর্মকর্তা আরো বলেন, চাষিদের প্রণোদনার বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ে চাষির তালিকা চেয়ারম্যান-মেম্বররা করেন। যে কারণে আমাদের আলাদাভাবে কিছু করার সুযোগ থাকে না।