মঙ্গলবার ভোর থেকে বেশ রাত অবধি খুব ব্যস্ততায় কেটেছে স্কুল শিক্ষক বীর সেন চাকমার। আগের রাতেই পাড়ার তরুণদের বলে রেখেছিলেন, সবাই যেন ভোরেই তাঁর বাড়িতে চলে আসে। তরুণরা যথাসময়ে এসে যাওয়ায় সবাই মিলে কাজেও নেমে গেছেন। প্রথমে সবার মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন বীর সেন চাকমা।
কেউ বাঁশ কেটে মশাল বানিয়েছে, কেউ মেঠো পথের দুই পাশে আড়াই হাত পর পর মশাল পুঁতেছে, কেউ বানিয়েছে ফুলের তোড়া। অতিথিদের জন্য প্যান্ডেল বানানো, চেয়ার-টেবিল নিয়ে আসা, খাবারের আয়োজনের দায়িত্বে ছিল আরেক দল। আর এত সব আয়োজন দেশ মাতিয়ে তোলা সাফজয়ী ফুটবলকন্যাদের মধ্যে পাহাড়ের পাঁচ মেয়ে ও তাঁদের দুই কৃতী শিক্ষককে ঘিরে।
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার মঘাছড়ি এলাকা থেকে জাতীয় দলের ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। সেখানে যেতে পাকা রাস্তা দূরের কথা, ভালোভাবে চলাচলের মতো কাঁচা রাস্তাও নেই। ফসলি জমির মাঝে হাতখানেক চওড়া আইলই ভরসা। দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথজুড়েই ছিল আলোর মশাল। এ জন্য ৩০ লিটার কেরোসিন ও ছয় কেজি পাটের দড়ি কেনা হয়েছিল। বীর সেন চাকমা সবই করেছেন গাঁটের পয়সা খরচ করে। শিষ্যরা এত বড় সাফল্য নিয়ে বাড়ি ফিরছে বলে কথা!
সাফজয়ী পাঁচ পাহাড়ি কন্যার গাড়িটি মঘাছড়িতে পৌঁছামাত্রই করতালিতে তাঁদের স্বাগত জানায় এলাকাবাসী। রুপনা, ঋতুপর্ণা, মনিকা, আনাই, আনুচিংকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তাঁদের শিক্ষাগুরু বীর সেন চাকমা। পরে সেই মেঠো পথ ধরে এই ফুটবলকন্যারা গেছেন সতীর্থ ঋতুপর্ণার বাড়িতে। ফুটবলাররা গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছেন, আর সামনে থেকে একের পর এক মশাল জ্বলে উঠেছে!
সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পর অনেকেই সংবর্ধনা দিয়েছে ফুটবলার মেয়েদের। কিন্তু ব্যতিক্রমী এই আয়োজন দেখে চমকেই গেছেন রুপনারা। ঋতুপর্ণা চাকমার কথায়ই তা স্পষ্ট, ‘আমাদের আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। ভাবতেই পারিনি এলাকায় এভাবে বরণ করে নেওয়া হবে আমাদের। সত্যিই ভীষণ চমকে গেছি। বীর সেন স্যার ও শান্তি মণি স্যারদের জন্যই আমরা এত দূর আসতে পেরেছি। ’
এই আয়োজনের উদ্যোক্তা বীর সেন চাকমা বললেন, ‘আজ আমাদের শূন্য ঘরে সুন্দর এলো। মেয়েদের ফুটবল খেলাকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখত। সবাইকে বোঝাতে চেয়েছি, মেয়েরা বোঝা নয়। বরং ঠিকঠাক পরিচর্যা করতে পারলে ওরা ফুল হয়ে ফুটবে। এ রকম আলোকিত মানুষ যেদিকে যাবে আশপাশ আলোকিত হবে। তাই এমন উদ্যোগ। ’
মঘাছড়ি থেকে আজ বিকেলে মোটর শোভাযাত্রা করে রাঙামাটি শহরে নেওয়া হবে পাঁচ ফুটবলারকে। জেলা স্টেডিয়ামে এই পাঁচজন এবং শিক্ষক বীর সেন চাকমা আর স্কুলের কোচ শান্তি মণি চাকমাকে সংবর্ধনা দেবে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা প্রশাসন ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
বীর সেন চাকমা মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এখন তাঁর কর্মস্থল উল্টাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাসখানেক পরেই অবসরে যাবেন বীর সেন। কর্মজীবনের শেষ বেলায় এসে অর্জন করলেন শিক্ষকতা জীবনেরই সবচেয়ে বড় গৌরবগুলোর একটি। রুপনা, ঋতুপর্ণা, মনিকা, আনাই, আনুচিংসহ জাতীয় ফুটবল দলের অনেক খেলোয়াড়ের উঠে আসার নেপথ্য কারিগর তিনি।
মঘাছড়ি স্কুলের মাঠ নেই। বীর সেন চাকমা তাই প্রতিদিন বিকেলে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যেতেন মেয়েদের। অনুশীলনের পর আবার নিয়ে আসতেন। একা কুলিয়ে উঠতে না পেরে একসময় অর্থের জন্য অনেকের কাছে হাত পেতেছেন। উপায় না পেয়ে খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়া এবং সরঞ্জামের খরচ মেটানোর জন্য নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ড পর্যন্ত ভেঙেছেন।
পিছিয়ে থাকা মেয়েদের ফুটবল খেলার পথটা মসৃণ করতে নিবেদিতপ্রাণ বীর সেনকে নিয়ে গত মঙ্গলবার ‘অবসরে’ পাতায় ছাপা হয়েছে ‘রুপনাদের জন্য ছিলেন বীর সেন’ নামে একটি প্রতিবেদন।