পরিবেশই জানিয়ে দিচ্ছিল এটা কোনো ঠাট্টা নয়। বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক যেন যথেষ্টই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিচ্ছিলেন, ‘দেখবেন, বিশ্বকাপের আগে আগে এমন কিছু ঘটবে যে আমি অধিনায়ক থাকব না।’
ভুল হলো। ওটা প্রথমবার নয়।
ততদিনে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এক যুগ কাটিয়ে দেওয়া তামিম ইকবালের এসব অনুধাবনে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি কিংবা জাতীয় দলের যে কোনো জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার চট করে বুঝে ফেলেন, তিনি বোর্ডের কোন আধিকারিকের কাছে কিংবা ড্রেসিংরুমে কত নম্বর জার্সিধারীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য। অবশ্য যে কোনো পরিণত মানুষের পক্ষেই কর্মস্থলে নিজের অবস্থান বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু ‘ঝামেলা’ পাঁকালেন তামিম নিজে। তাঁর অধীনে দারুণ সব জয় এসেছে। এমন অবস্থায় তামিমকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাতে বাড়ে অস্বস্তি। তামিম ঠিকই বুঝতে পারেন। যদিও এতদিনের অভিজ্ঞতায় এসবকে পাল্টা অবহেলায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজ করে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু সব মানুষকে তো আর এক পাল্লায় মাপা যায় না। ব্যাটার হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেই পারেন তামিম। অধিনায়কত্ব নিয়ে বৃহষ্পতিবার রাতে তিনি যে সাফল্যের কথা বলেছেন, সেটাকেও বাড়াবাড়ি মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তবে আয়নার সামনে যতবার দাঁড়িয়েছেন, ততবারই ভেবেছেন অধিনায়ক পদে তিনি ‘ওয়েলকামড’ নন।
অধিনায়কত্ব পাওয়ার দিন থেকে এই পরিস্থিতি তাঁকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। যতদূর মনে পড়ে, সদা হাস্যোজ্জ্বল, ‘কেয়ারফ্রি’ তামিম খোলসবন্দী। সেই উচ্ছ্বলতা নেই।
ক্রিকেটীয় ভাবনার দিগন্তের প্রায় পুরোটাই ছড়িয়ে দিয়েছেন দলে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সতীর্থদের কম্ফোর্ট, দল ও একাদশ নির্বাচন নিয়ে ভাবনার চাপ পড়েছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছিল তামিমের মনোজগতে। অধিনায়কত্বের মেয়াদকালে নিজেকে তিনি অসংখ্যবার প্রশ্ন করেছেন, ‘যেখানে আমি স্বাগত নই, সেখানে আমি আছি কেন?’ ক্রিকেট তাঁকে উজার করে দিয়েছে। তবে এই ক্রিকেটের বাইরেও তাঁর আলোকজ্জ্বল একটা জীবন আছে। যে জীবন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটার হওয়ার আগেই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তামিমকে। তাতে মনে হয় না বেঁচে থাকার জন্য তাঁর কাছে বিকল্পের কোনো অভাব আছে।
তবু একজন পেশাদারীর কাছে তাঁর কর্মস্থল সবচেয়ে আবেগের। ক্রিকেটারের কাছে ক্রিকেট তো মহামূল্য। অর্থ এবং খ্যাতি মিলিয়ে জীবনের সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা। সেখান থেকে আচমকা বিদায় বলা কঠিন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের পর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার পর তামিমও মুষড়ে পড়েছিলেন। চাপ থেকে মুক্তির স্বস্তি ছিল ঠিকই। তবে, ‘কী বলেন? আমি একজন ক্রিকেটার। এতদিন খেলেছি। এভাবে ছেড়ে দিয়ে অবশ্যই খারাপ লাগছে।’ এই খারাপের ক্ষতে সেদিন প্রলেপ দিয়েছিল তামিমের একটা ভাবনাই- এভাবে অবহেলার শিকার হয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
অবহেলা যে তামিম ইকবালের স্ক্যান রিপোর্ট নিয়েই হয়েছিল, তা বৃহষ্পতিবার স্বীকার করেছেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানও। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ডিসেম্বরে করানো এমআরআই রিপোর্টে তামিমের মেরুদণ্ডের নীচের হাঁড়ের ডিস্কে ধরা পড়া ক্ষতকে পাত্তাই দেয়নি টিম ম্যানেজমেন্ট! বরং তামিমের এই চোটকে ‘নাটক’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে। চোট থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত অনুশীলন করানো হয়েছে তাঁকে।
সদ্য এসব জেনে ক্ষুব্ধ বিসিবি সভাপতি। যদিও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে কিনা, সে নিশ্চয়তা নেই। কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে এমন নাম সামনে চলে আসবে, যা বোর্ডের বর্তমান কাঠামোর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তবে লোক দেখানো একটা প্রতিনিধান হতে পারে, হয়তো কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হতে পারে বিসিবির মেডিক্যাল টিমকে। বোর্ড নিযুক্ত সেই ডাক্তারের দল পিঠে কর্তার অকারণ ‘কিল’ নীরবে হজমও করে নিবে। কারণ, বোর্ড নিযুক্ত চিকিৎসক দলের তো কর্তাকে পাল্টা বলার উপায় নেই যে এই চোটের খবর ই-মেইল মারফত টিম ম্যানজমেন্টের শীর্ষব্যক্তিকে জানানো হয়েছিল যথাসময়ে। কিন্তু ‘হাতুড়ে’ সে চিকিৎসকের মনে হয়েছে, এটা গুরুতর কিছু না। উল্টো বোর্ড সভাপতিকে তামিম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাই দিয়েছিলেন তিনি।
অতপর সমস্যার গভীরে কি যাবে বোর্ড? মনে হয় না। সামনেই টানা খেলা, বিশ্বকাপের উত্তাল স্রোত আছে। তামিমের চোট নিয়ে অবেহলার বিষয়টি সেই স্রোতে ভেসে যাবে। তাই ধারণা করছি, মেডিক্যাল টিমকে কড়া ভাষায় চিঠি দিবে বোর্ড। বেতনভুক্ত চিকিৎসক দল সেটি মেনে নেবে। এবং বিশ্বকাপের পর তামিম ইকবাল আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট থেকে নীরবে অবসরে চলে যাবেন। তবে রেখে যাবেন একটা প্রশ্ন- অত আগে থেকে তামিম ইকবালের কেন মনে হতো যে, বিশ্বকাপে তিনি অধিনায়ক থাকবেন না?
এই প্রশ্নের উত্তর বোর্ডকে খুঁজে বের করতে হবে, ক্রিকেটের স্বার্থে। এটা তামিমের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানোর জন্য নয়। এটা ক্রিকেট সংস্কৃতির সমস্যা উৎপাটনের স্বার্থেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী। বিসিবির শীর্ষকর্তাদের কেউ কেউ আত্মজিজ্ঞাসাতেও পেয়ে যেতে পারেন উত্তরটি। তবে আবেগ কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নয়, পেশাদার মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে!